১৯৯৮ সালের বন্যায় বিধ্বস্ত কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে প্রথমবারের মতো পা রাখেন নরওয়েজিয়ান কবি ভেরা সিদার। তিনি এসেছিলেন একজন গবেষক ও মানবতাবাদী হিসেবে, কিন্তু যা পেলেন তা ছিল সাংস্কৃতিক সম্পদের এক অনন্য রূপ। ভাঙা ঘর, বিধ্বস্ত মানুষ, ক্ষতবিক্ষত চর… এসবের মাঝেও তিনি শুনলেন নারীদের মুখে ভেসে আসা গান- যা শুধু সুর ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার এক দর্শন। চলুন জেনে নেই ভেরা সিদারের মায়ের তরী সম্পর্কে অজানা গল্প।
চরের গানে জীবন ও আত্মার গল্প
বাউল, মারফতি, মুর্শিদি এইসব গানের সুর যেন চরের নারীদের আত্মার ভাষা। ভেরা ভাষা না বুঝেও বুঝে ফেললেন গানের গভীরতা। তিনি অনুভব করলেন, এই গানই চরবাসীর মানসিক শক্তির উৎস, যা প্রজন্ম ধরে চলে আসছে।
মন ছুঁয়ে যাওয়া সুরের প্রেমে
নরওয়ে ফিরে গিয়েও ভেরা এই সুরকে ভুলতে পারলেন না। বাংলা ভাষা শেখা শুরু করলেন, গানের অনুবাদ পড়লেন, এবং স্বপ্ন দেখলেন এই সাংস্কৃতিক রত্নকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার।
ভেরা সিদারের মায়ের তরী শুরুটা যেভাবে হলো
২০১৬ সালে তিনি স্থানীয় শিল্পীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘মায়ের তরী’ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন যা প্রান্তিক শিশুদের লোকসংগীত শেখানোর মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস, শিক্ষা ও আত্মপরিচয় গড়ে তোলে। নামটি তিনি নিজেই রাখেন “মা” মানে মাতৃভূমি, আর “তরী” মানে সেই মায়ের বুকে ভেসে চলা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

গুরুগৃহ: মাটির ঘরে সুরের পাঠশালা
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে ৯টি গুরুগৃহ গড়ে উঠেছে যেখানে শিশুরা একতারা, বাঁশি, তবলা, ঢোল, বেহালা শেখে। তারা শিখছে লালন ফকিরের গান, বাউল ভাবনা এবং আধ্যাত্মিক দর্শন। কোনো শাস্তি নেই, শুধু ভালোবাসা ও সুর।
লালন ফকির ও মানবতার গান
ভেরা সিদার লালনের গান থেকে শিখলেন মানবতার আসল অর্থ। তিনি ৫৩টি লালনের গান নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং একটি বই প্রকাশ করেন যা নরওয়ের পাঠকদের মুগ্ধ করে। এই অনুবাদ ছিল শুধু ভাষান্তর নয়, ছিল দুই সংস্কৃতির মাঝে এক সেতুবন্ধন।
মায়ের তরী সঙ্গীতই হল সঙ্গী
মায়ের তরী শুধু গান শেখায় না, শেখায় ভালো মানুষ হওয়ার পথ। শিশুরা তাদের শেকড়কে জানতে পারছে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। তাদের মাঝে কেউ কেউ এখন রেডিওতে গাইছে, কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত নিয়ে পড়ছে।
ইতিবাচক পরিবর্তনের ঢেউ
লোকসংগীত এখন আর ‘পুরানো’ কিছু নয় এটি এখন গর্বের বিষয়। গ্রামের অভিভাবকরাও এখন সন্তানদের গান শেখাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। মায়ের তরীর কার্যক্রমে সামাজিক সংহতি, সংস্কৃতি চর্চা, এবং মানসিক বিকাশ সবই এসেছে।
আজও ভেসে চলেছে সেই তরী
৮০ বছর বয়সেও তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেও গান পৌঁছাবে, চর অঞ্চলের শিশুরাই হবে ভবিষ্যতের লালন, হাসন, করিম। তাঁর দেখানো পথেই আজ এগিয়ে চলেছে মায়ের তরী বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনার এক চিরন্তন যাত্রা।
লোকগান, ভালোবাসা ও ভবিষ্যতের কথা
ভেরা সিদার প্রমাণ করেছেন, সঙ্গীতের কোনো সীমানা নেই। ভালোবাসা, মানবতা ও সংস্কৃতি নিয়ে গড়ে ওঠা মায়ের তরী আজ বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের গর্ব। এই উদ্যোগ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি আত্মিক বিপ্লব।




