মাগরিবের নামাজ হলো ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে একটি ওয়াক্ত। সূর্যাস্তের পরে পড়া এই নামাজ আমাদের আত্মিক শান্তি, ধৈর্য এবং আল্লাহর নৈকট্য বৃদ্ধি করে। এই গাইডে আপনি পাবেন মাগরিবের নামাজের নিয়ম, রাকাত সংখ্যা, নিয়ত, সময়, ফজিলত, দোয়া, হাদিস, ভুল– ত্রুটি এবং সাধারণ প্রশ্নোত্তর সহ সবকিছু একসাথে।
মাগরিবের নামাজের রাকাত সংখ্যা
মাগরিব নামাজের মোট রাকাত সংখ্যা ৫।
- ২ রাকাত সুন্নত (ফরজের পরে)
- ৩ রাকাত ফরজ
বিঃদ্র- মাগরিবের ফরজ নামাজের পূর্বে ২ রাকাত সুন্নত নামাজ (অনেকে নফল মনে করেন) রয়েছে। সহিহ বুখারী ও মুসলিম হাদিস গ্রন্থে এই সুন্নতটির কথা এসেছে তবে এই সুন্নাতটির উপর অধিকাংশই আমল করেন না।
মাগরিবের নামাজের সময়
মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত শুরু
সূর্য সম্পূর্ণ অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে মাগরিব নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়।
মাগরিবের নামাজের শেষ সময়
পশ্চিম আকাশে লালিমার অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত এই ওয়াক্ত বিদ্যমান থাকে।
মাগরিবের নামাজের নিয়ত
ইসলামে প্রত্যেক আমল বা ইবাদতের ভিত্তি হলো নিয়ত। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন “সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১নং)
অর্থাৎ, একজন মানুষ তার আমলের মাধ্যমে আসলে কী উদ্দেশ্য রাখছে, সেটিই আল্লাহর কাছে আসল মানদণ্ড।
নিয়ত মানে হলো – অন্তরে দৃঢ় সংকল্প করা যে, আমি নির্দিষ্ট একটি নামাজ বা ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আদায় করব। নামাজের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নিয়ত ছাড়া নামাজ শুদ্ধ হয় না।
নিয়ত মুখে বলা বাধ্যতামূলক নয়; বরং মনে মনে স্থির করা বা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করাই যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব, এশা বা কোনো সুন্নত বা নফল নামাজ পড়তে হলে অন্তরে নির্দিষ্ট করতে হবে
ফরজ নামাজের পূর্বে ২ রাকাত সুন্নত নামাজের নিয়ত:
উদাহরণস্বরূপ, মাগরিবের ফরজ সালাতের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নত নামাজের নিয়ত হবে “আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কেবলামুখী হয়ে মাগরিবের ফরজের পূর্বে ২ রাকআত সুন্নত নামাজ আদায়ের নিয়ত করছি।” এভাবে মনে মনে নিয়ত স্থির করে নামাজ শুরু করার সময় বলতে হবে- “আল্লাহু আকবার” (তাকবীরে তাহরিমা)।
এভাবেই নামাজ শুরু হয়। কেউ চাইলে নিজের ভাষায় বা সহজভাবে মনে মনে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করতে পারে। মুখে উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে মনে দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা রাখা জরুরি।
মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামাজের নিয়ত:
মাগরিবের ফরজ নামাজের নিয়ত হবে “আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কেবলামুখী হয়ে মাগরিবের ৩ রাকআত ফরজ নামাজ আদায়ের নিয়ত করছি।”
এভাবে মনে মনে নিয়ত স্থির করে নামাজ শুরু করার সময় বলতে হবে- “আল্লাহু আকবার” (তাকবীরে তাহরিমা)।
মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত নামাজের নিয়ত:
মাগরিবের ফরজ নামাজের পর ২ রাকাত সুন্নাত নামাজের নিয়ত হবে “আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কেবলামুখী হয়ে মাগরিবের ২ রাকআত সুন্নাত নামাজ আদায়ের নিয়ত করছি।”
এভাবে মনে মনে নিয়ত স্থির করে নামাজ শুরু করার সময় বলতে হবে- “আল্লাহু আকবার” (তাকবীরে তাহরিমা)।
মাগরিবের ৩ রাকাত ফরজ নামাজ পড়ার নিয়ম
অতি সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া হলোঃ
১. নিয়ত করে নামাজ শুরু করুন।
২. ফাতিহা ও ছোট সূরা পড়ুন।
৩. রুকু ও সেজদা সম্পন্ন করুন।
৪. দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতও একইভাবে পড়ুন।
৫. শেষ রাকাতে তাশাহহুদ, দরুদ শরিফ, দোয়া মাসুরা পড়ুন ও সালাম দিয়ে নামাজ শেষ করুন।
মাগরিবের ২ রাকাত সুন্নত নামাজের নিয়ম
- প্রথম রাকাতে ফাতিহা + ছোট সূরা পড়ুন।
- রুকু ও সেজদা সম্পন্ন করুন।
- দ্বিতীয় রাকাতও একইভাবে সম্পন্ন করুন।
ফরজের পূর্বের ২ রাকাত কিংবা ফরজের পরের ২ রাকাত সুন্নাত নামাজের নিয়ম একই। সকল সুন্নাত নামাজের নিয়ম একই।
নামাজ পড়ার বিস্তারিত নিয়ম পড়ুন এখানে ক্লিক করে
মাগরিব নামাজের পর দোয়া
ফরজ নামাজের পর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অনেক দোয়া এবং জিকির করতেন সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হলোঃ-
১️। আল্লাহু আকবার – একবার উচ্চস্বরে।
২️। أَسْتَغْفِرُ الله (আস্তাগফিরুল্লাহ) – ৩ বার।
৩️। اَللّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ…
অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি শান্তির উৎস এবং তোমার কাছ থেকেই শান্তি আসে।” (মুসলিম ১/৪১৪)
৪️। لا إله إلا الله وحده لا شريك له…
অর্থ: “আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; তিনিই সর্বশক্তিমান।”
৫️। اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ…
অর্থ: “তুমি যা দাও তা কেউ আটকাতে পারে না।” (বুখারী, মুসলিম)
৬️। সুবহানাল্লাহ ৩৩, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩, আল্লাহু আকবার ৩৩ শেষে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…” একবার।
৭️। সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস প্রতিটি ৩ বার করে।
৮️। আয়াতুল কুরসি ১ বার।
ফজিলত: এসব দোয়া পাঠ করলে পাপ ক্ষমা হয়, মন শান্ত হয় ও বরকতপূর্ণভাবে কাটবে আপনার প্রতিটি দিন।
মাগরিবের নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
মাগরিবের নামাজের গুরুত্ব
কালেমা শাহাদতের পর সালাত ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি ঈমানের প্রতীক ও মুসলমানের পরিচয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকে সালাতের ব্যাপারে উদাসীন।
যে ব্যক্তি কখনো নামাজ পড়ে না, সে ইসলামের মৌলিক বিধান অস্বীকার করছে এটি কুফরির সমান বড় অপরাধ। আবার কেউ কেউ অলসতার কারণে মাঝে মাঝে নামাজ আদায় করে, কখনো করে না। ইসলামী দৃষ্টিতে এ আচরণও গুরুতর গুনাহ।
সালাত কেবল একটি আমল নয়, এটি আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের জীবন্ত প্রতীক। একজন প্রকৃত মুসলমানের উচিত জীবনের প্রতিটি দিনে সালাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং একে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা।
মাগরিবের নামাজের ফজিলত
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ غَدَا إِلَى الْـمَسْجِدِ أَوْ رَاحَ أَعَدَّ الله لَهُ فِي الْـجَنَّةِ نُزُلًا كُلَّمَا غَدَا أَوْ رَاحَ».
“যে ব্যক্তি জামা‘আতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে আসা-যাওয়া করলো আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে সকাল ও সন্ধ্যায় এক বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন”। সহীহ বুখারী, হাদীস – ৬৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৬৬৯।
মাগরিবের নামাজ সংক্রান্ত হাদিস
১. রাত অন্ধকার হওয়ার পূর্বেই মাগরিবের সালাত আদায় করা
মুহাম্মাদ ইবনু বাশার (রহ.) ….. আবূ বিশর (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হাসান ইবনু বিলাল (রাঃ)-কে নবী (সা.) -এর সহচরদের মধ্য হতে আসালাম সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি হতে বর্ণনা করতে শুনেছি যে, নবী (সা.) -এর সাহাবীগণ তার সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করতেন। তারপর মদীনার প্রান্তরে নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেতেন। এমতাবস্থায় তারা তীর নিক্ষেপ করতেন এবং তারা তীর পতনের স্থান দেখতে পেতেন (অর্থাৎ- রাত অন্ধকার হওয়ার পূর্বেই মাগরিবের সালাত আদায় করতেন)। হাদিস একাডেমি নাম্বারঃ ৫২০ , আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৫২১ সহীহ: মুসনাদে আহমাদ ২৩১৯৭, বুখারী ৫৫৯, মুসলিম ৬৩৭।
২. সালামা বিন আকওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের সালাত আদায় করতেন, যখন সূর্য ডুবে যেতো এবং সূর্য-গোলক অদৃশ্য হয়ে যেতো। ”সহীহ মুসলিম: ৬৩৬; তিরমিযী: ১৬৪;
মাগরিবের নামাজে সাধারণ ভুল ও সতর্কতা
- সময়মতো নামাজ না পড়া
- নামাজে অমনোযোগী হওয়া
- রাসুল (সাঃ) দেখানো পদ্ধতিতে সালাত আদায় না করা
মাগরিবের নামাজে মনোযোগ ধরে রাখার উপায়
- আজানের পূর্বেই মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- নামাজের সময়ের পঠিত দোয়া ও তাসবিহ গুলোর বাংলা অর্থ জানুন।
- সূরা ও দোয়া মুখস্থ রাখুন
মাগরিবের নামাজ FAQ
১. মাগরিবের নামাজ কয় রাকাত?
মোট ৫ রাকাত- ২ সুন্নত + ৩ ফরজ।
২. মাগরিবের নামাজের নিয়ত কেমন?
নিয়ত: আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত মনে মনে স্থির করা ।
৩. মাগরিব নামাজের সময় কখন শুরু হয়?
সূর্যাস্তের পর।
৪. মাগরিব নামাজে কোন সূরা পড়তে হয়?
ফাতিহার পরে ছোট কোনো সূরা যেমন আল-ইখলাস বা আল-ফালাক কিংবা অন্যান্য সূরা তেলাওয়াত করা।
৫. মেয়েদের মাগরিব নামাজের নিয়ম কেমন?
পুরুষদের নিয়ম অনুসরণ, সংযমী পোশাকে নামাজ পড়া।
৬. মাগরিবের নামাজের ফজিলত কী?
- আধ্যাত্মিক শান্তি অর্জন
- নেকি অর্জন
- আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা
৭. মাগরিবের শেষ সময় কখন?
যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন আকাশের পশ্চিম দিক লালচে রঙ ধারণ করে। এই লালচে আলো কিছুক্ষণ থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
যতক্ষণ এই লালচে আভা বা আলো থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মাগরিবের সময় থাকে। সহিহ আবু দাউদ হাঃ ৪২৪
৮. মাগরিবের কসর নামাজের নিয়ম কী?
শুধুমাত্র চার রাকআত বিশিষ্ট ফরজ সালাত। যেমন- যোহর, আসর ও এশা। পক্ষান্তরে ফজর ও মাগরিবের কোন কসর নাই। (অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম)
৯. মাগরিব শব্দের অর্থ কী?
“মাগরিব” অর্থ সূর্যাস্ত।




