বিশ্ব রাজনীতির পরাশক্তিগুলোর সম্পর্ক আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির সংকট, বাণিজ্য, সামুদ্রিক রুট-সবকিছুকে ঘিরে তাদের প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। আর এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার এক উদীয়মান শক্তি-বাংলাদেশ।
ভূরাজনীতির অদৃশ্য দড়ি টানাটানির এই সময়ে বাংলাদেশ যেন তিন পরাশক্তির লড়াই এর কেন্দ্র। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চোখে এক নতুন কৌশলগত ক্ষেত্র। তবে আশার কথা হচ্ছে-এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের জন্য তৈরি করছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বৈশ্বিক স্বীকৃতির নতুন দরজা।
প্রকৃতি, সম্পদ ও ক্ষমতার লড়াই- ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
মানবসভ্যতার শুরু থেকেই পানি, বন, খনিজ-এসব সম্পদের দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে।
মহামারি থেকে জলবায়ু বিপর্যয়-প্রতিটি সংকট মানুষকে দিয়েছে নতুন শিক্ষা, নতুন উদ্ভাবন।
প্রকৃতির সাথে অভিযোজনেই টিকে আছে মানবজাতি।
কিন্তু আজকের লড়াই আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়- মানুষে মানুষে ক্ষমতার প্রতিযোগিতাই এখন বড় বাস্তবতা।
বিশুদ্ধ পানি ও নির্মল বায়ু এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান দুই সম্পদ। আর এই সম্পদকে কেন্দ্র করেই ভবিষ্যতে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মোড়: সামুদ্রিক রুট, বন্দর ও পানির উৎস দখলে প্রতিযোগিতা
বিশেষজ্ঞদের মতে,
- ২১শ শতকের তেলের লড়াইয়ের মতো
- ভবিষ্যতের লড়াই হতে পারে পানির উৎস এবং সামুদ্রিক পথ নিয়ন্ত্রণ ঘিরে।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর-
যা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বৈশ্বিক লজিস্টিক্সের প্রাণরস।
এখানেই বাংলাদেশ পেয়েছে কৌশলগত গুরুত্ব।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি (IPS)-দুই পক্ষই বাংলাদেশের অবস্থানকে তাদের স্বার্থের কেন্দ্র হিসেবে দেখছে।
কোভিড-১৯-এর পর নতুন বিশ্ব: পূর্বের দিকে শক্তির সরণ
কোভিড-১৯ পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে।
চীন মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে নিজেকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
BRI-সংযুক্ত দেশগুলোকে চিকিৎসা, টিকা ও সহায়তা দিয়ে চীন তার প্রভাব আরও বিস্তৃত করেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় পুনরায় তার প্রভাব শক্তিশালী করতে চায়।
এই কারণে দক্ষিণ এশিয়া এখন তিন পরাশক্তির প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে-
এবং এখানে বাংলাদেশই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়।
কেন বাংলাদেশ এখন কৌশলগতভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ?
১️. ভৌগোলিক অবস্থান – Global Supply Chain Hub
বাংলাদেশ হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত উপমহাদেশ, চীন ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থল।
যে দেশ এই রুট ব্যবহার করবে- তার বাণিজ্য বাড়বে বহুগুণ।
২️. বঙ্গোপসাগর- নতুন জ্বালানি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র
গভীর সমুদ্রবন্দর, ব্লু ইকোনমি, মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক খনিজ- সবই আগ্রহের জায়গা।
৩️. দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় অর্থনীতি।
এই সম্ভাবনাকে নিজের প্রভাব অঞ্চলে রাখতে চায় উভয় পরাশক্তি।
৪️. যুবসমাজ ও মানবসম্পদ
ইউরোপ ও এশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের দক্ষ মানবসম্পদ এখন বড় সম্পদ।
তিন পরাশক্তির লড়াই- বাংলাদেশের জন্য সুযোগ নাকি ঝুঁকি?
এই প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ইতিবাচক দিক হলো-
বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতাকে ঝুঁকি নয়, সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ যেভাবে লাভবান হচ্ছে:
- আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়ছে
- অবকাঠামো উন্নয়ন ত্বরান্বিত
- রপ্তানি বাজারে নতুন সুযোগ
- কূটনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি
- আঞ্চলিক সংযোগ উন্নয়ন
- সামুদ্রিক নিরাপত্তা শক্তিশালী হচ্ছে
তিন পরাশক্তি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করতে বাধ্য–
এটাই ২১শ শতকের ভূরাজনীতির নতুন বাস্তবতা।
বৈশ্বিক টানাপোড়েনের মাঝেও উজ্জ্বল বাংলাদেশ
আজকের পৃথিবী পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে।
পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতা থামবে না-
কিন্তু বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত শক্তি।
আর এটাই বড় সুখবর-
পরাশক্তিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বাংলাদেশের উন্নয়নই হতে যাচ্ছে এই দড়ি টানাটানির সবচেয়ে বড় ফল।




