মেরুদণ্ডের ডিস্ক প্রোল্যাপস বা স্লিপ ডিস্ক আজকাল একটি অত্যন্ত পরিচিত রোগ। কোমর বা ঘাড়ের প্রচণ্ড ব্যথা, পা বা হাত অসাড় হয়ে যাওয়া, ঝিম ধরা এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত-এই সমস্যাগুলোর মূলে থাকে ডিস্ক প্রোল্যাপস। অনেকেই ভাবেন, এর একমাত্র সমাধান হলো বড় ধরনের অস্ত্রোপচার। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আজ আর সেই ভয় নেই। ডিস্ক প্রোল্যাপস লেজার চিকিৎসা এসেছে এক নিরাপদ, দ্রুত এবং কার্যকরী সমাধান হিসেবে।
ডিস্ক প্রোল্যাপস কী?
আমাদের মেরুদণ্ডের কাঁচের মতো অস্থিগুলোর (ভার্টিব্রা) মধ্যে থাকে একটি নরম স্তর, যাকে ডিস্ক বলে। এই ডিস্কগুলো আমাদের মেরুদণ্ডকে নড়াচড়া করতে এবং সঞ্চারিত চাপ সহ্য করতে সাহায্য করে। কোনো কারণে এই ডিস্কের বাইরের শক্ত অংশ ফেটে গিয়ে ভেতরের নরম জেলির মতো পদার্থটি বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী স্নায়ুতে চাপ দিলে তাকে ডিস্ক প্রোল্যাপস বলে। এই চাপের কারণেই তীব্র ব্যথা ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।
লেজার চিকিৎসা কীভাবে কাজ করে?
ডিস্ক প্রোল্যাপসের লেজার চিকিৎসাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘পারকিউটেনিয়াস লেজার ডিস্ক ডিকম্প্রেশন’ (Percutaneous Laser Disc Decompression – PLDD)। এটি একটি অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি। এর প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত:
- স্থানীয় চেতনানাশক: রোগীকে ঘুম পাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ইনজেকশনের মাধ্যমে কোমরের নির্দিষ্ট স্থান অসাড় করে দেওয়া হয়।
- সূক্ষ্ম সুই প্রবেশ: এক্স-রে মেশিনের (ফ্লোরোস্কোপি) সাহায্যে চিকিৎসক সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে সমস্যাযুক্ত ডিস্কে একটি সূক্ষ্ম সুই প্রবেশ করান।
- লেজারের প্রয়োগ: ওই সুইয়ের মধ্য দিয়ে একটি লেজার ফাইবার পাঠানো হয়। লেজারের তাপ ডিস্কের ভেতরের জেলির একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশকে গ্যাসে পরিণত করে বাষ্পীভূত করে দেয়।
- চাপ কমানো: জেলির এই অংশ বাষ্পীভূত হয়ে গেলে ডিস্কের ভেতরের চাপ কমে যায়। ফলে, বেরিয়ে আসা অংশটি আবার ভেতরে ঢুকে যাওয়ার সুযোগ পায় এবং স্নায়ুর উপর থেকে চাপ নেমে যায়।
সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি মাত্র ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয় এবং রোগীকে সেদিনই বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।
কেন এটি একটি নিরাপদ সমাধান?
ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রোপচারের তুলনায় লেজার চিকিৎসা অনেক নিরাপদ এবং কার্যকরী। এর কারণগুলো হলো:
- অস্ত্রোপচারবিহীন: এখানে কোনো বড় কাটা বা সেলাই নেই। শুধুমাত্র একটি সূক্ষ্ম পিনের মতো ছিদ্র থাকে।
- কম রক্তক্ষরণ: প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ছোট এলাকায় সম্পন্ন হওয়ায় রক্তক্ষরণের ঝুঁকি নগণ্য।
- দ্রুত পুনরুদ্ধার: রোগী প্রক্রিয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাঁটতে পারেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে অনেক কম সময় লাগে।
- সংক্রমণের ঝুঁকি কম: বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শ এত কম থাকায় ইনফেকশনের আশঙ্কা খুবই কম।
- মেরুদণ্ডের গঠন অক্ষুণ্ণ থাকে: এই চিকিৎসায় মেরুদণ্ডের হাড় বা পেশী কাটা হয় না, ফলে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন ও গতিশীলতা বজায় থাকে।
কাদের জন্য এই চিকিৎসা উপযুক্ত?
সব ধরনের ডিস্ক প্রোল্যাপস রোগীর জন্য লেজার চিকিৎসা উপযুক্ত নয়। একজন অভিজ্ঞ মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এমআরআই (MRI) রিপোর্ট ও শারীরিক পরীক্ষার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাধারণত যাদের ডিস্ক সামান্য বা মাঝারি ভাবে প্রোল্যাপস হয়েছে (Contained Disc Herniation) এবং ওষুধ বা ফিজিওথেরাপিতে উন্নতি হচ্ছে না, তারাই এই চিকিৎসার জন্য আদর্শ প্রার্থী।
উপসংহার
ডিস্ক প্রোল্যাপসের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আর বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের কথা ভাবার দরকার নেই। লেজার চিকিৎসা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অসাধারণ উপহার, যা ন্যূনতম ঝুঁকিতে সর্বোচ্চ সুফল দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক রোগ নির্ণয় এবং একজন অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত মেরুদণ্ড বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। তিনিই আপনার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবেন।