গত বছরের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার টানা আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন এবং অনলাইনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে বারবারই তিনি দেশের মাটিতে ফিরে আসার ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। তবে এখনো পর্যন্ত সেটি বাস্তবের মুখ দেখেনি, ফলে অনেকেই তার এসব বক্তব্যকে ‘কাগুজে হুঙ্কার’ হিসেবেই দেখছেন।
এরই মাঝে আবারও আলোচনায় এসেছে হাসিনার দেশে ফেরার পরিকল্পনা। ভারতের কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নিউটাউন শাখা দুর্গাপূজার পর থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে বলে গুঞ্জন চলছে। দীর্ঘ সময় ধরে ভারত এবং তাদের সমর্থিত মহল শেখ হাসিনার অতীত কর্মকাণ্ড-বিশেষ করে গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো পাশ কাটিয়ে তাকে আবারো রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
‘র’-এর ছায়ায় প্রচারণা যুদ্ধ
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা Research and Analysis Wing (RAW) বা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে তোলা হচ্ছে একটি সমন্বিত প্রচারণা কাঠামো। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মহল ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক সময়কার বাম নেতা গৌতম রায়, যিনি শেখ হাসিনার প্রশংসা করে তাকে সুফিয়া কামাল, সুচিত্রা মিত্র ও গৌরী আইয়ুবের মতো নারীদের সঙ্গে তুলনা করেন। এমনকি তিনি দাবি করেন, হাসিনা এতটাই কর্মব্যস্ত ছিলেন যে জীবনে ঠিকমতো দুপুরের খাবারও খেতে পারেননি।
এই সম্মেলনকে ঘিরে ‘র’-এর সহায়তা থাকার অভিযোগ তুলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই আয়োজন ছিল জনমত গঠনের একটি কৌশলী পদক্ষেপ।
ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয় প্রচারণা
শুধু সম্মেলন নয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও চলছে তৎপরতা। অভিযোগ রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের একটি ওয়েব পোর্টাল নিয়মিতভাবে আওয়ামীপন্থিদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই পোর্টালটির পরিচালক নাকি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়েছেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের অর্থ দিয়ে হাসিনার পক্ষে পোস্ট করানো হচ্ছে।
এ তৎপরতায় দেখা যাচ্ছে-ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মনগড়া বাস্তবতা তুলে ধরে হাসিনার ভাবমূর্তি পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে। পিডিএফ ফাইল, এডিট করা ভিডিও এবং নানা ধরনের মনগড়া তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে তা দিল্লি, কলকাতা এবং ঢাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘প্রক্সি প্রভাব’?
বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব চিত্রে এই প্রচার-প্রচারণা কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপের কারণে বাংলাদেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে হাসিনাকে পুনঃস্থাপন করাটা সহজ হবে না।
তবে এর মধ্যেও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীর দিল্লি যাতায়াত বেড়েছে। এমনকি শোনা যাচ্ছে, পূজার পর কলকাতার একদল হাসিনাপন্থী বুদ্ধিজীবী বড় ধরনের প্রচারণামূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন, যার পেছনে ‘র’-এর পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।
ড. ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার
একইসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, এই প্রচারণা যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ইউনূসবিরোধী প্রচারে সক্রিয় রয়েছে একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, যারা বিভিন্ন ভুয়া তথ্য তৈরি করে তা মিডিয়া ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
শেষ কথা: সময়ই বলবে কী হবে পরিণতি
সব মিলিয়ে, শেখ হাসিনার ফেরার সম্ভাবনা ঘিরে ভারতীয় মিডিয়া ও আওয়ামী লীগপন্থীদের নানা তৎপরতা এখন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বাস্তব রাজনীতি এবং জনমতের বিচারে আদৌ তিনি দেশে ফিরতে পারবেন কিনা-তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে আরও স্পষ্টতা আসতে পারে।