বুধবার, নভেম্বর ১৯, ২০২৫

সব গুনাহ মাফের দোয়া: সায়্যিদুল ইস্তিগফারের অর্থ ও ফজিলত

বহুল পঠিত

মানুষের জীবনে ভুল-ত্রুটি একটি স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। আমরা অনেক সময় অজান্তেই ভুল করে ফেলি। এসব অপরাধ আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে মলিন করে। তবে মহান স্রষ্টা অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তার বান্দাদের তাওবা কবুল করতে ভালোবাসেন। ইসলামে গুনাহ মাফের দোয়া অনেক রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিশেষ একটি দোয়া বা ইস্তেগফার রয়েছে। আজকের আলোচনায় আমরা সেই শক্তিশালী দোয়া সম্পর্কে জানব। এটি হলো সায়্যিদুল ইস্তিগফার বা সকল ইস্তিগফারের সর্দার। এর মাধ্যমে একজন মুমিন তার রবের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে পারে।

সায়্যিদুল ইস্তিগফার উচ্চারণ ও অর্থ

হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি দোয়া শিখিয়েছেন। এটিকে সকল ইস্তিগফারের সেরা ইস্তিগফার বলা হয়। দোয়াটি হলো:

সায়্যিদুল ইস্তিগফার আরবিতে

للَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ

সায়্যিদুল ইস্তিগফার উচ্চারণ

আল্লা-হুম্মা আনতা রব্বী লা ইলা-হা ইল্লা আনতা খালাক্বতানী, ওয়া আনা ‘আবদুকা ওয়া আনা ‘আলা ‘আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাসতাত্বা‘তু, আ‘ঊযুবিকা মিন শার্রি মা ছানা‘তু। আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়া ওয়া আবূউ বিযাম্বী ফাগফিরলী ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয্ যুনূবা ইল্লা আনতা।

সায়্যিদুল ইস্তিগফার অর্থ

হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনারই বান্দা। আমি আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর আছি, যতটুকু সাধ্য আমার। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। আমি আপনার প্রতি আমার অপরাধ স্বীকার করছি। আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় গুনাহ ক্ষমা করার ক্ষমতাতো শুধু আপনারই আছে।

সায়্যিদুল ইস্তিগফারের ফজিলত: জান্নাতের সুসংবাদ 

এই দোয়ার ফজিলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি অবিশ্বাস্য সুসংবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি দিনের বেলায় (সকালে) এই প্রার্থনাটি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে পড়বে এবং সন্ধ্যার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতি হবে। আর যে ব্যক্তি রাতের বেলায় (সন্ধ্যা বা রাতের প্রথম ভাগে) এটি পড়বে এবং সকালের আগে মৃত্যুবরণ করবে, সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই হাদিসটি সহিহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, এই ফরিয়াদের মর্যাদা কত উচ্চ। এটি শুধু গুনাহ মাফের মাধ্যম নয়, বরং জান্নাত লাভের একটি কারণ। তাই প্রতিদিন এই দোয়াটি আমল করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একজন মুমিনের জন্য অপরিহার্য আমল।

সায়্যিদুল ইস্তিগফারের তাৎপর্য: একটি পূর্ণাঙ্গ তাওবা 

এই প্রার্থনাটি শুধু কিছু শব্দের সমষ্টি নয়, এর রয়েছে গভীর তাৎপর্য। এখানে একজন বান্দা তার স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। প্রথমেই সে স্বীকার করছে যে আল্লাহ তার একমাত্র রব। এরপর সে নিজেকে আল্লাহর দাস হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। সে স্বীকার করছে যে সে সৃষ্টি এবং আল্লাহ তাঁর স্রষ্টা। এটি তাওহীদের সুন্দর বহিঃপ্রকাশ। এরপর সে তার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করছে। সে তার নিজের কৃতকর্মের খারাপ পরিণাম থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছে। এটি একজন বান্দার নম্রতা ও দুর্বলতার প্রকাশ।

অন্তরের আন্তরিকতা: ক্ষমা লাভের মূল শর্ত 

কোনো আমলই আন্তরিকতা ছাড়া সফল হয় না। এই দোয়ার ক্ষেত্রেও তাই। হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে ‘পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে’। এর মানে হলো শুধু মুখে পড়লেই হবে না, অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে হবে। বান্দাকে তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে। সে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ভবিষ্যতে আর সে এই অপরাধ করবে না। এই আন্তরিকতা ও অনুশোচনাই তাওবাকে সত্যিকার অর্থে কবুলযোগ্য করে। আল্লাহ অন্তরের অবস্থা দেখেন। তিনি জানেন বান্দার অন্তরে কি রয়েছে। তাই প্রার্থনার সাথে অন্তরের বিশুদ্ধতা থাকা আবশ্যক। এটি ক্ষমা পাওয়ার জন্য অপরিহার্য।

সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠের উত্তম সময়

যেকোনো সময় এই দোয়া পড়া যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে পড়লে এর ফজিলত বেড়ে যায়। হাদিসে যেহেতু সকাল ও সন্ধার পড়ার ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। তাই ফজরের পরে ও আসরের পরে এটি পড়া খুবই উত্তম। এছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরে এই ইস্তিগফার পড়তে পারেন তবে এই সালাতের আবশ্যক মনে করা যাবেনা। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে যখন আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন, তখন এই ফরিয়াদ করা খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে। নিয়মিত দোয়াটি করলে একজন মুমিন তার জীবনকে পাপমুক্ত রাখতে পারে। এটি একটি অসাধারণ অভ্যাস।

ক্ষমার পথে নিয়মিত চলা 

সায়্যিদুল ইস্তিগফার হলো আল্লাহর দরবারে পৌঁছানোর একটি অসাধারণ মাধ্যম। এটি আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আমাদের আমলকে কবুল করাতে সাহায্য করে। এই দোয়া শুধু পড়েই ক্ষান্ত না হয়ে, আমাদের জীবনে তাওবার চর্চা করতে হবে। আমাদের নিয়মিত ইস্তিগফার পড়া উচিত। এটি আমাদের মনে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের তাওবা কবুল করার জন্য অপেক্ষা করেন। তাই আমরা যেন তাঁর দয়া ও ক্ষমা থেকে বঞ্চিত না হই। নিয়মিত এই প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। এটিই হলো সফলতার মূল চাবিকাঠি।

সায়্যিদুল ইস্তিগফার সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর ( FAQ)

১. সর্বোত্তম ইস্তেগফার কোনটি?

উত্তরঃ সাইয়েদুল ইস্তেগফার।

২. সাইয়েদুল ইস্তেগফার কোন সুরার আয়াত?

উত্তরঃ সাইয়েদুল ইস্তেগফার (তাওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া) কোনো একটি নির্দিষ্ট সুরার আয়াত নয়, এটি একটি হাদিস-ভিত্তিক দোয়া।

৩. সাইয়েদুল ইস্তেগফার কতবার পড়া উচিত?

উত্তরঃ হাদিসে সকাল সন্ধায় পড়ার ফযিলতের কথা উল্লেখ রয়েছে

৪. তাওবার শক্তিশালী দোয়া কোনটি?

উত্তরঃ সাইয়েদুল ইস্তেগফার

৫. সবচেয়ে ছোট ইস্তেগফার কোনটি?

উত্তরঃ সবচেয়ে ছোট ইস্তেগফার হলো ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (أَسْتَغْفِرُ اللهَ)

৬. ইস্তেগফার পড়লে কি হয়?

উত্তরঃ ইস্তেগফার পড়লে পাপ ক্ষমা হয়, রিজিকের বরকত বাড়ে, দুশ্চিন্তা দূর হয়।

৭. ইস্তেগফার কতবার পড়া উচিত?

উত্তরঃ ইস্তেগফারের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, তবে এটি বেশি বেশি পড়া উচিত। রাসুল (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারেরও বেশি ইস্তেগফার পড়তেন।

৮. ওযু ছাড়া ইস্তেগফার পড়া যাবে কি?

উত্তরঃ যখন খুশি দুআ করতে যায়, ওজু করার দরকার নেই।

৯. অজু ছাড়া কি তসবি পড়া যায়?

উত্তরঃ হ্যাঁ, অজু ছাড়া তসবি পড়া যায়, এটি জায়েজ ।

১০. ওযু না থাকলে দুআ করা যাবে কি?

উত্তরঃ যখন খুশি দুআ করতে যায়, ওজু করার দরকার নেই।







আরো পড়ুন

ম দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম – সুন্দর অর্থসহ সেরা নামের তালিকা

বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম পরিবারগুলোতে সন্তানের জন্য সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখার আগ্রহ সর্বদা ছিল এবং থাকবে। বিশেষ করে ম দিয়ে মেয়েদের ইসলামিক নাম খোঁজার ক্ষেত্রে অভিভাবকরা বেশ সচেতন থাকেন, কারণ নাম শুধু পরিচয়ের নয়—এটি চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের একটি ইতিবাচক প্রতিফলন।

সূরা ফীল বাংলা উচ্চারণ, আরবি, অর্থ, তাফসীর ও ফজিলত – সম্পূর্ণ গাইড

ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা আছে, যা মানুষের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে। সূরা ফীল ঠিক সেই ধরনের একটি সূরা। মাত্র পাঁচ আয়াতের হলেও এতে আছে আল্লাহর কুদরতের জীবন্ত প্রমাণ, অহংকারের কঠিন পরিণতি এবং দুর্বলের প্রতি আল্লাহর বিশেষ সুরক্ষা।

সূরা কদরের বাংলা অর্থ ও উচ্চারণ: লাইলাতুল কদরের মহিমা, আমল ও ফজিলত

পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুরা গুলোর মধ্যে সুরা কদর একটি। এই সূরা মূলত লাইলাতুল কদরের রাতের মহিমা এবং কুরআন নাজিল হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে। এই লেখায় সূরা কদরের বাংলা অর্থ ও উচ্চারণ, ফযিলত সহ সবকিছু জানব।
- Advertisement -spot_img

আরও প্রবন্ধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ প্রবন্ধ