তাহাজ্জুদ নামাজ হলো এমন এক নফল ইবাদত, যা মুমিন বান্দাকে আল্লাহর সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে যায়। রাতের নীরবতায় যখন চারপাশ নিস্তব্ধ, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের আহ্বান করেন, “কে আছে যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তাই দিয়ে দেব?” তাহাজ্জুদ সেই সময়ের ইবাদত, যেখানে আল্লাহর রহমত দরজাগুলো খোলা থাকে। তাই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জানা জরুরী।
এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত জানব- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, কত রাকাত, কখন পড়তে হয়, কীভাবে নিয়ত করতে হয়, দোয়া ও ফজিলতসহ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি?
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো রাতের একটি নফল নামাজ যা গভীর রাতে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য আদায় করা হয়। এটি ইসলামী শরিয়তে “কিয়ামুল লাইল” বা রাতের সালাত নামে পরিচিত।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন – “আর রাতে কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করুন; এটি আপনার জন্য অতিরিক্ত নফল। সম্ভবত তোমার প্রভু তোমাকে প্রশংসিত মর্যাদায় উঠিয়ে দেবেন।” (সূরা ইসরাঃ ৭৯)
এই আয়াত প্রমাণ করে, তাহাজ্জুদ শুধু নামাজ নয়, বরং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের মর্যাদা অর্জনের মাধ্যম।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত?
তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা নির্ধারিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ এবং শেষে ৩ রাকাত বিতর নামাজ পড়তেন।
তবে ফিকহবিদদের মতে –
- সর্বনিম্ন: ২ রাকাত পড়তে হবে
- সর্বাধিক: ২+২+……. ( যতখুশি পড়তে পারেন তবে ধীরে ধীরে পড়তে হবে )
অর্থাৎ আপনি যত রাকাত পড়তে পারেন, ততই বরকত ও সওয়াব বৃদ্ধি পাবে।
তাহাজ্জুদ কখন পড়তে হয়
তাহাজ্জুদের সময় শুরু হয় এশার নামাজের পর থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত।
তবে সবচেয়ে উত্তম সময় হলো- রাতের শেষ তৃতীয়াংশে (সাহরির আগে সময়)।
রাসুল (সা.) বলেছেন: “আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশ আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ । মহান আল্লাহ্ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ’যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট যা কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তাই দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব।’ (সহীহ : বুখারী ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮)
- তাই রাত ২টা থেকে ফজরের আগে পর্যন্ত সময় তাহাজ্জুদের জন্য সর্বাধিক বরকতময়।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার প্রস্তুতি
তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি:
- ঘুম থেকে উঠে প্রথমে ওযু করা।
- শান্ত পরিবেশে ইবাদতের মনোভাব তৈরি করা।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
যেকোনো ইবাদতের মতো তাহাজ্জুদ নামাজের জন্যও নিয়ত করা অত্যন্ত জরুরি। ইসলাম ধর্মে নিয়ত ছাড়া কোনো আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন “নিশ্চয়ই প্রত্যেক আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, মিশকাত – হাদীস ১নং)
এই হাদীসটি স্পষ্টভাবে বোঝায় যে, যে কোন আমলই হোক না কেন, আগে নিয়ত থাকা আবশ্যক।
নিয়তের অর্থ কী?
“নিয়ত” মানে হলো – মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করা যে, আমি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট একটি নামাজ আদায় করব।
নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা সুন্নত নয়, বরং হৃদয়ে স্থির করা যথেষ্ট। নামাজকে বিশুদ্ধ (সঠিক) করার জন্য এই আন্তরিক সংকল্পই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত কীভাবে করবেন?
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য নিয়ত করার সময় মনে মনে ভাববেন-
“আমি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, কেবলার দিকে দারিয়ে দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য প্রস্তুত হলাম নামাজ শুরু করলাম।” এর পর তাকবীরে তাহরিমা আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করবেন।
নিয়তের গুরুত্ব কেন এত বেশি?
- নিয়তই আমলকে আল্লাহর পথে নিবেদিত করে।
- আন্তরিক নিয়তের মাধ্যমেই যে কোন আমলের কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
নিয়ত হচ্ছে আমলের প্রাণ। তাই তাহাজ্জুদ নামাজ শুরু করার আগে অন্তর দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিয়ত করুন এটাই ইবাদতের আসল সৌন্দর্য।
তাহজ্জুদ নামাজেরর কিরা’আত
আবদুল্লাহ ইবনু আবু কাইস (রহঃ) বর্ণনা করেন: “আমি আয়িশাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম- রাতের নামাজে (তাহাজ্জুদে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিরআত কেমন করতেন? তিনি কি নীরবে তিলাওয়াত করতেন, না উচ্চস্বরে?”
আয়িশা রাঃ উত্তর দিলেন “কখনও তিনি নিচু স্বরে (নীরবে) এবং কখনও উঁচু স্বরে কিরআত পাঠ করতেন।”
বর্ণনাকারী বলেন “আমি বললাম, সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি এ বিষয়ে প্রশস্ততা (অর্থাৎ বিকল্পের সুযোগ) রেখেছেন।” (সহীহ আবু দাউদ, হাদীস ১২৯১; সহীহ মুসলিম)
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম খুব সহজ। এটি ঠিক সাধারণ নফল নামাজের মতোই, পার্থক্য শুধু রাতের বেলা পড়তে ঘুম থেকে জেগে আদায় করা হয়। অন্যান্য সময়ের নফল নামাজের তুলনায় তাহাজ্জুতের ফজিলত অনেক অনেক বেশি।
ধাপে ধাপে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম:
- সুন্দর করে ওযু করুন।
- কিবলামুখী হয়ে মনোযোগ সহকারে দাঁড়ান।
- নিয়ত করুন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার।
- অন্যান্য ২ রাকাত নামাজের মতই নামাজ পড়ুন।
- সরবে কেরাত পড়ার হাদিস রয়েছে।
- প্রতিটি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর যেকোনো সূরা পাঠ করুন।
- নামাজ শেষে বা নামাজের আল্লাহর কাছে দোয়া করুন ও ইস্তেগফার করুন।
- ২+২+২+…. রাকাত করে পড়তে হবে।
আজকের সকল নামজের সময়সূচি জানুন।
তাহাজ্জুদ নামাজে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে দোয়া পড়তেন
তাহাজ্জুদের সময় নবী করিম (সা.) দীর্ঘ সময় কিয়াম, রুকু ও সেজদায় কাটাতেন।
ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন দু‘আ পড়তেন-
আরবি পাঠ (Arabic Text)
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ مَلِكُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ وَوَعْدُكَ الْحَقُّ وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ وَقَوْلُكَ حَقٌّ وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ حَقٌّ اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَوْ لآ إِلَهَ غَيْرُكَ
قَالَ سُفْيَانُ وَزَادَ عَبْدُ الْكَرِيمِ أَبُو أُمَيَّةَ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ قَالَ سُفْيَانُ قَالَ سُلَيْمَانُ بْنُ أَبِي مُسْلِمٍ سَمِعَهُ مِنْ طَاوُسٍ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم
বাংলা উচ্চারণ:
“আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু, আন্তা কাইয়্যিমুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ়ি ওয়া মান ফিহিন্না।
ওয়া লাকাল হামদু, লাকা মুলকুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ়ি ওয়া মান ফিহিন্না।
ওয়া লাকাল হামদু, আন্তা নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ়।
ওয়া লাকাল হামদু, আন্তাল হাক্কু, ওয়া ওয়াদুকাল হাক্কু, ওয়া লিকাউকাল হাক্কু, ওয়া কাওলুকাল হাক্কু, ওয়াল জান্নাতু হাক্কুন, ওয়ান নারু হাক্কুন, ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কুন, ওয়া মুহাম্মাদুন ﷺ হাক্কুন, ওয়াস্সা‘আতু হাক্কুন।
আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু, ওয়া বিকা আমানতু, ওয়া ‘আলাইকা তাওাক্কালতু, ওয়া ইলাইকা আনাবতু, ওয়া বিকা খাসামতু, ওয়া ইলাইকা হাকামতু, ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখখারতু, ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লানতু, আন্তাল মোকাদ্দিমু ওয়া আন্তাল মুআখখিরু, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা।”
বাংলা অনুবাদ ও অর্থ:
হে আল্লাহ! আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা।
আপনি আসমান ও জমিনের এবং তাদের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর রক্ষাকারী ও নিয়ামক।
আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা।
আপনি আসমান ও জমিনের মালিক।
আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা।
আপনি আসমান ও জমিনের নূর (আলো)।
আপনি চির সত্য, আপনার ওয়াদা সত্য, আপনার সাক্ষাৎ সত্য, আপনার বাণী সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মাদ ﷺ সত্য, কিয়ামত সত্য।
হে আল্লাহ! আমি আপনারই প্রতি আত্মসমর্পণ করেছি, আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার উপরই নির্ভর করেছি, আপনার দিকেই ফিরে এসেছি, আপনার সন্তুষ্টির জন্যই অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি বা বিরোধ করি।
তাই আপনি আমার অতীত ও ভবিষ্যৎ, প্রকাশ্য ও গোপন সব গুনাহ মাফ করে দিন।
আপনিই অগ্র-পশ্চাতের মালিক।
আপনি ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই।”
(hadithbd.com থেকে সংগ্রহীত ) (৬৩১৭, ৬৩৮৫, ৭৪৪২, ৭৪৯৯; মুসলিম ৬/৩, হাঃ ৭৬৯, আহমাদ ২৮১৩) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৫৪)
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও উপকারিতা
তাহাজ্জুদ নামাজ ইসলামের এমন এক অনন্য নফল ইবাদত, যা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুরআন ও সহীহ হাদীস উভয়েই তাহাজ্জুদের গুরুত্ব, মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্যবার আলোকপাত করা হয়েছে। এটি এমন এক নামাজ যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে, হৃদয় পরিশুদ্ধ করে এবং আত্মাকে প্রশান্তি দেয়।
কুরআনে তাহাজ্জুদের ফজিলত
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন “আর রাত্রির কিছু অংশ (কুরআন পাঠসহ) জাগ্রত থাকুন। এটি আপনার জন্য একটি অতিরিক্ত (নফল) ইবাদত। হয়তো আপনার পালনকর্তা আপনাকে মোকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্থানে) পৌঁছাবেন।” [সূরা আল-ইসরা ১৭:৭৯]
ব্যাখ্যা:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সরাসরি নবী করিম ﷺ-কে নির্দেশ দিয়েছেন রাতের কিছু অংশে ইবাদত করতে — অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে। এর বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন “মাকামে মাহমুদ”, অর্থাৎ এমন এক প্রশংসিত ও সম্মানিত অবস্থান, যা কিয়ামতের দিনে শুধুমাত্র নবীজি ﷺ-এর জন্য নির্ধারিত হবে।
তবে ইসলামী ব্যাখ্যাগুলিতে বলা হয়েছে, এই আয়াত শুধু নবীর জন্য নয়, বরং প্রতিটি ঈমানদার বান্দার জন্যও অনুপ্রেরণা – যেন তারা রাতের নীরবতায় আল্লাহর কাছে নিজেদের নিবেদন করে।
দৈনন্দিনের দোয়া ও আমল করুন পড়ুতে ক্লিক করুন।
প্রিয় নবীজি (সা.) এর অতি প্রিয় আমল তাহাজ্জুদ
রাসুল (সা.) তাহাজ্জুদ নামাজ বাদ দিতেন না।
আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) ও তাহাজ্জুদ নামাজের অনুপ্রেরণা
ইসলামের ইতিহাসে সাহাবারা রাতের নামাজকে (তাহাজ্জুদ) আল্লাহর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করতেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ)-এর উদাহরণ খুবই অনুপ্রেরণামূলক।
একবার আবদুল্লাহ (রাঃ) একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা তিনি তার বোন উম্মুল মু’মিনীন হাফসাহ (রাঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলেন। হাফসাহ (রাঃ) তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানান। তখন নবী ﷺ বললেন:
“আবদুল্লাহ কতই না ভাল লোক! যদি রাত জেগে সে সালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করত!”
এই প্রশংসা শুনে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) পরবর্তী জীবনে খুব অল্প ঘুমাতেন এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে থাকেন।
হাদীসের সূত্রসমূহ:
- মুসলিম: ৪৪/৩২, হাঃ ২৪৭৯
- অন্যান্য সূত্র: ১১৫৭, ৩৭৩৯, ৩৭৪১, ৭০১৬, ৭০২৯, ৭০৩১
- আধুনিক প্রকাশনী: ১০৫১ শেষাংশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ১০৫৫ শেষাংশ
তাহাজ্জুদ নামাজের উপকার
- আত্মার প্রশান্তি: তাহাজ্জুদ পড়লে অন্তর শান্ত হয়।
- দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠ সময়: এই সময়ের দোয়াগুলো সবচেয়ে দ্রুত কবুল হয়।
- পাপ মোচনের উপায়: রাতের নিস্তব্ধতায় অনুতপ্ত অন্তর আল্লাহর কাছে ক্ষমা পায়।
- মানসিক শক্তি বৃদ্ধি: নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়লে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
- রিযিকের বরকত: তাহাজ্জুদের অভ্যাস রিযিকে বরকত আনে।
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব
আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাযি.) হতে বর্ণিত:
“আমি একবার স্বপ্নে দেখলাম যেন দুইজন ফেরেশতা আমাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি বললাম- আমি তো আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি! পরে আমি সে স্বপ্ন আমার বোন, উম্মুল মু’মিনীন হাফসাহ (রাযি.)-এর কাছে বর্ণনা করলাম। তিনি সেই স্বপ্নটি আল্লাহর রাসূল ﷺ-কে জানালেন।
তখন নবী করিম ﷺ বললেন –
‘আবদুল্লাহ কতই না ভালো মানুষ! যদি সে রাত জেগে সালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করত!’
এরপর থেকে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাযি.) খুব অল্প সময়ই ঘুমাতেন।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৭৯)
তাহাজ্জুদের মাধ্যমে একজন বান্দা নিজের গুনাহ মোচন, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করে।
তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি
আল্লাহ তাআলা নবী করিম ﷺ-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন:
“হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী (নবী)! রাত্রির কিছু সময় জেগে উপাসনা কর। অর্ধরাত্রি বা তার চেয়ে কিছু বেশি বা কম সময় জাগ্রত থাকো। কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট এবং সুন্দরভাবে। আমি তোমার উপর গুরুত্বপূর্ণ বাণী অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা মুজাম্মিল শুরুর আয়াত গুলো)
এটি আমাদেরকে শেখায় যে রাত্রির ইবাদত (তাহাজ্জুদ) শুধুমাত্র রাত জেগে নামাজ আদায় করা নয়, বরং এটি হৃদয়ঙ্গম ও মননশীল কুরআন পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
এ আয়াত গুলো প্রমাণ করে, তাহাজ্জুদ শুধু ইবাদত নয়, এটি এক অভ্যন্তরীণ শান্তির উৎস।
তাহাজ্জুদ নামাজের বাস্তব সুফল
আজকের দ্রুতগতির জীবনে তাহাজ্জুদ হলো মানসিক শান্তির প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক থেরাপি। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন-
- তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা বেড়ে যায়,
- বিষণ্ণতা কমে,
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
তাহাজ্জুদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক শক্তি ও ঈমানের গভীরতা এনে দেয়।
তাহাজ্জুতের মাধ্যমে আত্মউন্নয়ন
তাহাজ্জুদ নামাজ কেবল ধর্মীয় অনুশীলন নয়; এটি আত্মউন্নয়নের একটি পথ।
- এটি আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়
- শৃঙ্খলা ও সময় ব্যবস্থাপনা তৈরি করে
- জীবনে ইতিবাচকতা আনে
যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হয়, সে কখনো হতাশ হয় না, কারণ সে প্রতিদিন আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে।
উপসংহার
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো শান্তি, প্রশান্তি ও বরকতের উৎস। এটি এমন এক ইবাদত, যা মানুষকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়।
আজ থেকেই শুরু করুন- প্রতিদিন অন্তত দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ।
দেখবেন, আপনার অন্তর প্রশান্ত হবে, জীবন আলোকিত হবে, দোয়া কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।
তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১️। তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল?
উত্তরঃ এটি নফল নামাজ ।
২️। তাহাজ্জুদ নামাজ কয় রাকাত?
উত্তরঃ সর্বনিম্ন ২ রাকাত, সর্বাধিক ২+২+২… করে পড়তে পারেন।
৩️। তাহাজ্জুদ নামাজ কোন সূরা দিয়ে পড়তে হয়?
উত্তরঃ সূরা আল-ইখলাস, আল-মুজাম্মিল, আল-মুলক, বা যেকোনো সূরা পাঠ করা যায়।
৪️। তাহাজ্জুদ নামাজ কি ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়?
উত্তরঃ হ্যাঁ, তাহাজ্জুদের বৈশিষ্ট্যই হলো ঘুম থেকে উঠে পড়া।
৫️। নারীরা কি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে পারেন?
উত্তরঃ অবশ্যই পারেন।
৬️। বিতর নামাজের পর তাহাজ্জুদ পড়া যাবে কি?
উত্তরঃ রাতের শেষ নামাজ হলো বেতের নামাজ। আগে তাহাজ্জুদ, পরে বিতর পড়া উত্তম।
৭️। তাহাজ্জুদ নামাজের সর্বনিম্ন কত রাকাত?
উত্তরঃ মাত্র ২ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়লেও বিশাল সওয়াব রয়েছে।
৮️। তাহাজ্জুদ নামাজ কি জামাতে পড়া যায়?
উত্তরঃ সাধারণত একা পড়াই উত্তম, তবে মাঝে মাঝে পরিবারসহ পড়া জায়েজ।
৯️। তাহাজ্জুদের উত্তম সময় কখন?
উত্তরঃ রাতের শেষ এক তৃতীয়াংশ, সাহরির সময়ের আগে।
১০। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে কি হয়?
উত্তরঃ মন শান্ত হয়, গুনাহ মোচন হয়, আল্লাহর নিকটত্ব অর্জিত হয়।
১১। নারীদের তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম কি?
উত্তরঃ নারীদের জন্যও তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম একই অর্থাৎ পুরুষরা যেভাবে পড়েন নারীরাও একই রকম ভাবে পড়বেন।




