দোয়া কুনুত হলো নামাজের এক বিশেষ দোয়া যা গোপন অন্তর থেকে অনুনয় ও শিষ্টতা প্রকাশ করে। এই প্রবন্ধে আমরা দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ, গুরুত্ব, ফজিলত, প্রয়োগ, হাদিস ভিত্তিক নির্দেশনা এবং সাধারণ প্রশ্নোত্তর বিশ্লেষণ করব।
দোয়া কুনুত বিভিন্ন মাজহাবে বিভিন্ন ভাবে পড়া হয়। তবে বাংলাদেশ এ হানাফি মাজহাব এর অনুসারী সবচেয়ে বেশি তাই আজকে আমরা হানাফি মাজহাব এ দোয়া কুনুত সম্পর্কে উল্লেখিত তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
দোয়া কুনুত আরবি
নিচে দোয়া কুনুতের মূল আরবি পাঠ দেওয়া হলো, যা মুসলিমরা এশার সলাতের পর বেতের নামাজের শেষ রাকাতে রুকুতে যাওয়ার আগে বা রুকু থেকে ওঠার পর উচ্চারণ করে থাকে:
اللّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْكَ وَنُثْنِي عَلَيْكَ الْخَيْرَ وَنَشْكُرُكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَّفْجُرُكَ، اللّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ، نَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخْشَى عَذَابَكَ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحِقٌ
দোয়া কুনুতের আরবি উচ্চারণ বাংলায়
আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাইনুকা, ওয়া নাস্তাগফিরুকা, ওয়া নু’মিনুবিকা, ওয়া নাতাওয়াক্কালু আলাইকা, ওয়া নুছনী আলাইকাল খায়র, ওয়া নাশকুরুকা, ওয়ালা-নাকফুরুকা, ওয়া নাখলাউ উয়া নাতরুকু মাইয়্যাফজুরুকা, আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা না’বুদু, ওয়ালাকা নুছল্লি, ওয়া নাসজুদু, ওয়া ইলাইকা নাস’আ, ওয়া নাহফিদু, ওয়া নারজু রাহমাতাকা, ওয়া নাখ্শা আজাবাকা; ইন্না আজাবাকা বিল‑কুফ্ফারি মুলহিক্।
(উচ্চারনের সময় মদ্দ, মাখরাজ সঠিক ভাবে পড়তে হবে)
দোয়া কুনুতের বাংলা অর্থ
হে আল্লাহ! আমরা আপনারই সাহায্য চাই, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস রাখি ও আপনার ওপর ভরসা করি। আপনি যে ভালো কাজের প্রশংসা, আমরা সেটা স্বীকার করি। আমরা কৃতজ্ঞ হই, অকৃতজ্ঞ হই না। যারা আপনার অবাধ্য, তাদের আমরা ত্যাগ করি। হে আল্লাহ! শুধুমাত্র আপনিই আমাদের ইবাদতের যোগ্য; আপনার জন্যই নামাজ পড়ি এবং সিজদা করি। আমরা আপনার দিকে দৌড়ে যাই এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করি। আমরা আপনার দয়া কামনা করি এবং আপনার শাস্তি এড়িয়ে চলি। নিশ্চয়ই আপনার শাস্তি অবিশ্বাসীদের জন্য ঘন ঘন আসে।
অনেকে আরও বর্ধিত বা পরিবর্তিত অনুবাদ দেন; তবে উপরের ভাবার্থ মূল অর্থ বহন করে।
দোয়া কুনুতের গুরুত্ব
- নামাজ প্রার্থনা ও অনুনয় করার অনন্য সুযোগ দেয়। দোয়া কুনুত সেই সময় হৃদয় থেকে আল্লাহর দিকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়।
- সালাতের সৌন্দর্য: নামাজকে শুধু নিয়মিত অঙ্গিকারের বাইরেও এক পরিপূর্ণ অনুশীলন হিসেবে গড়ে তোলে।
- আত্মিক শান্তি: অনেকে বর্ণনা করেন কুনুত পড়লে মন শান্ত হয়, আশা জেগে ওঠে।
- সুন্নাহ অনুবর্তিতা: নবী ﷺ অনেক রাতে দোয়া কুনুত পড়েছেন এবং তা এটি সুন্নাহর অংশ।
দোয়া কুনুতের ব্যবহার (কখন ও কোথায় পড়া হয়)
- বিতর নামাজে: হানাফি মাযহাব অনুসারে, বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে, রুকুতে যাওয়ার আগে কুনুত পড়া ওয়াজিব।
- সাধারণ নামাজে বিপদ–নাজিলা অবস্থায়: মুসলিম সভ্যতায় দুর্যোগ, দুঃসংকট বা কল্যাণের সময় কিছু মাযহাব কুনুতে নাজিলা (দরিদ্রদের প্রার্থনায় বিশেষ কুনুত) পড়ার অনুমোদন দেয়।
- ফজর সালাতে (শাফি ও কিছু সম্প্রদায়): ফজর নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে ঐ সময় কুনুত পড়া হয়, যদিও মাযহাবভেদে মতবৈচিত্র্য রয়েছে।
দোয়া কুনুত পড়ার ফজিলত
- গুনাহ মাফ: অনেক পাঠক বিশ্বাস করেন, কুনুত পড়লে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা বেশি আসে।
- দূরত্ব পেরিয়ে মঙ্গল লাভ: শত্রু, দুর্যোগ ও বিপদ থেকে সুরক্ষা কামনায় প্রার্থনায় এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
- আধ্যাত্মিক উত্তরণ: কুনুত মানুষের অন্তরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায় এবং বিশ্বাসকে জোরদার করে।
দোয়া কুনুত সম্পর্কিত হাদিস
- আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল ﷺ অত্যন্ত বিপদে কুনুত পাঠ করতেন এবং বিশেষ প্রার্থনায় পরিবর্তিত দোয়া করতেন।
- কিতাবুল হুজ্জাহ গ্রন্থে বর্ণিত, এক রাতে রাসুল ﷺ মিশর করেন, তিনি বিতর নামাজে কুনুত পাঠ করেছিলেন।
হাদিসের প্রামাণ্য ও ইসলামী স্কলারদের ব্যাখ্যা ভেদে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে পারে। তাই বিষয়টি বিস্তারিত ফিকহ গ্রন্থ ও স্কলারদের আলোচনায় নিয়ে ভাবা উত্তম।
দোয়া কুনুত সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
দোয়া কুনুত কোথায় পড়তে হয়?
বিতর নামাজের তৃতীয় রাকাতে, বর্তমানে রুকুতে যাওয়ার আগে (কিয়াম অবস্থা) বা রুকুতে যাওয়ার পরে দোয়া কুনুত পড়া হয়।
দোয়া কুনুত কোন সূরার কত নম্বর আয়াত?
কুনুত কোনো কোরআনীয় আয়াত নয় । এটি একটি দোয়া যা সহিহ হাদিসে উল্লেখিত আছে। তাই তা কোনো সূরার অধীন নয়।
দোয়া কুনুত পড়ার ফজিলত কি?
উপরের অংশে উল্লেখিত ফজিলতের আলোকে বলা যায়- গুনাহ মাফ, হৃদয়ের শান্তি, কল্যাণ কামনা, বিপদ থেকে রক্ষা, এগুলোই মূল বিশ্বাসভিত্তিক ফল।
দোয়া কুনুতের বদলে কি পরা যায়?
বিশেষ ক্ষেত্রে যদি আপনি কুনুত মুখস্থ না জানেন, তাহলে সংক্ষিপ্ত সুন্নাহ বা ইচ্ছা অনুযায়ী দোয়া পড়া যেতে পারে বিশেষ করে নাজিলা (দুর্যোগ) অবস্থায়।
পরবর্তী করণীয় ও অনুকরণ
- মুখস্থ করুন: শুরুতে দোয়া কুনুত মুখস্থ করতে চেষ্টা করুন- এতে নামাজের সময় স্বচ্ছন্দ হবে।
- দৈনন্দিন প্রয়োগ: যতটা সম্ভব বিতর নামাজে সময়মত কুনুত পড়ার চেষ্টা করুন।
- প্রশ্নানুসন্ধান চালান: স্থানীয় ইমাম ও ইসলামী স্কলারদের সাথে আলোচনা করুন মাযহাবভেদ ও বিস্তারিত প্রয়োগ নিয়ে।
- সার্বিক দোয়া: দোয়া কুনুতের পাশাপাশি আপনার নিজস্ব হৃদয় থেকে আল্লাহর প্রতি প্রার্থনা চালিয়ে যান।




