রংপুর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত তাজহাট জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক ও মনোমুগ্ধকর স্থাপনা। সাদা রঙের রাজকীয় এই প্রাসাদটি একসময় তাজহাট জমিদার পরিবারের বাসভবন ছিল। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ও জাদুঘর, যা দেশের সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী।
স্থাপত্যের মহিমা: ইউরোপীয় নকশায় রাজকীয় সৌন্দর্য
তাজহাট জমিদার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী ইউরোপীয় নকশা দ্বারা অনুপ্রাণিত। এর সম্মুখভাগে বিশাল সিঁড়ি, গম্বুজ ও খিলানযুক্ত বারান্দা একে রাজপ্রাসাদের আভিজাত্য এনে দিয়েছে। সুবিশাল লন, সুশোভিত বাগান ও বিশাল গেট পুরো এলাকাকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়।
দূর থেকেই এই স্থাপনাটি রংপুরের গর্ব হিসেবে চোখে পড়ে।
ইতিহাস: জমিদারি আমল থেকে রাজবাড়ির উত্থান
ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে মার্তিন ডন নামের একজন ব্যবসায়ী এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র ধর্মপ্রিয় দত্ত বাড়িটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করেন। তিনি ছিলেন দানশীল ও প্রজ্ঞাবান জমিদার, যিনি এলাকার শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে “রাজা” উপাধি প্রদান করে। এরপর থেকেই এটি তাজহাট রাজবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
পুনর্জন্ম: আদালত থেকে জাদুঘরে রূপান্তর
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়, এবং রাজবাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তবে ১৯৮৪ সালে ভবনটি হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যা স্থাপনাটিকে নতুন জীবন দেয়।
পরে ২০০৪ সালে এটি পুনরায় সংস্কার করে রংপুর বিভাগীয় জাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এখানে দেশের ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।
যাদুঘরের সংগ্রহ: ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়
তাজহাট রাজবাড়ির জাদুঘরে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন ও মূল্যবান নিদর্শন, যেমনঃ
- হিন্দু ধর্মীয় কালো পাথরের ভাস্কর্য
- প্রাচীন চারুলিপি ও তাম্রলিপি
- মুঘল আমলের নকশাদার শিল্পকর্ম
- জমিদার পরিবারের ব্যবহৃত আসবাবপত্র ও অলঙ্কার
এই সংগ্রহগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস, ধর্মীয় বৈচিত্র্য এবং শিল্প ঐতিহ্যের অমূল্য দলিল হিসেবে কাজ করে।
ইতিবাচক প্রভাব: রংপুরের গর্ব ও পর্যটনের সম্ভাবনা
তাজহাট জমিদার বাড়ি এখন রংপুরের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে আসেন। এটি শুধু ইতিহাস জানার স্থান নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিকাশে অবদান রাখছে।
সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত পরিচর্যার ফলে ভবনটি ধীরে ধীরে আবারও তার পুরোনো জৌলুস ফিরে পাচ্ছে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
তাজহাট জমিদার বাড়ি শুধু একটি স্থাপনা নয় এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গর্বিত প্রতীক। সঠিক সংরক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীতের অনুপ্রেরণা হিসেবে টিকে থাকবে।
রংপুরের এই রাজকীয় ঐতিহ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিবাচক পরিবর্তন আসে যখন আমরা আমাদের শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকি।




