বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
আজকের আলোচনার বিষয় আসরের নামাজ সম্পর্কে। ইনশাআল্লাহ সহিহ দলিল অনুযায়ী আমরা জানব আসরের কত রাকাত ফরজ, কত রাকাত সুন্নাত, কত রাকাত নফল, নামাজের নিয়ম, সময় ও সহীহ দোয়ার বিষয়গুলো।
আসরের নামাজের রাকাত ও সময়
প্রথমত, আসরের নামাজের রাকাত সংখ্যা, উপযুক্ত সময় এবং নামাজের নিয়ম সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
আসরের নামাজ কত রাকাত
মোট আসরের নামাজ ৮ রাকাত। এর মধ্যে ৪ রাকাত ফরজ এবং ফরজের আগে ৪ রাকাত সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ (যা অতি গুরুত্ব সহকারে পালনীয় নয়, তবে ফজিলতপূর্ণ)।
ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি জামাতে পড়া সম্ভব না হয়, তাহলে একাকী পড়া যায়।
তাছাড়া, ফরজের আগে ৪ রাকাত সুন্নাত পড়লে বিশেষ ফজিলত পাওয়া যায়, কিন্তু না পড়লে কোনো গুনাহ নেই।
আসরের নামাজের সময়
দ্বিতীয়ত, সময় জানা জরুরি।
আসরের ওয়াক্ত শুরু হয় যখন কোনো বস্তুর ছায়া তার মূল দৈর্ঘ্যের সমান হয়। এটি শেষ হয় যখন ছায়া দ্বিগুণ হয়। তবে সূর্যাস্তের আগে রক্তিম আলো পর্যন্ত নামাজ পড়া বৈধ। (সূত্র: আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৮৩)
আসরের নামাজের শুরুর সময়
কোনো বস্তুর মূল ছায়ার এক গুণ হওয়ার পর থেকে আসরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয়।
আসরের নামাজের শেষ সময়
যখন কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হয় তখন ওয়াক্ত শেষ হয়। তবে সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত পড়া বৈধ।
আসরের নামাজের নিয়ম বিস্তারিত
আসরের নামাজের নিয়ত
নিয়ত মানে হলো উদ্দেশ্য বা সংকল্প। সালাত শুরু করার আগে নিয়ত করা অত্যন্ত জরুরি।“নিশ্চয়ই প্রত্যেক আমলসমূহই তো নিয়তের উপরেই নির্ভরশীল।” (বুখারী,মুসলিম, মিশকাত ১নং)। তাই সালাতের জন্য ওযু করে পবিত্র হয়ে, পরিচ্ছন্ন পোশাক ও মন-দেহের সাথে কাবা-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে, অন্তরে দৃঢ় সংকল্পে, আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে বিনম্র চিত্তে দাঁড়াতে হবে। এটি মনে মনে বলা অথবা মনে মনে স্থির করা, যা নামাজকে বিশুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য। মনে মনে বলতে পারেন “আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেবলার দিকে দাড়িয়ে আসরের রাকআত ফরজ নামাজের জন্য প্রস্তুত হলাম নামাজ শুরু করলাম” (এভাবে নিজের মত করে মনে মনে ভাবতে পারেন।)
তাকবীরে তাহরিমা (নামাজ শুরুর সময় আল্লাহু আকবার বলা)
ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে, দুই হাতের আঙুলগুলো খাড়া করে কাঁধ বা কান পর্যন্ত উঁচু করা হয় এবং এই অবস্থায় দুনিয়ার সবকিছুকে তুচ্ছ করে আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করতে বলা হয়, “আল্লাহু আকবার” অর্থাৎ আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। এরপর বাম হাতের উপর ডান হাত বুকের উপর রেখে, হৃদয় নিবেদিত চিত্তে সিজদার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার স্থান বরাবর রেখে দণ্ডায়মান হয়।
ছানা পড়া
ছানা অর্থ প্রশংসা। এটি মূলত দো‘আয়ে ইস্তেফতাহ বা সালাতের শুরুতে পাঠ করার দো‘আ।
১.
سُبْحَانَكَ اَللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالِىْ جَدُّكَ وَلَا اِلَهَ غَيْرُكَ
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আপনার নাম অতি বরকতময়। আপনি সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী এবং আপনি ছাড়া কোনো উপাসক নেই। (আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৩, ৮০৪; নাসায়ি, হাদিস: ৮৯৯, ৯০০)
অথবা
২.
اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ ”.
‘‘হে আল্লাহ! আমার এবং আমার গুনাহের মধ্যে এমন ব্যবধান করে দাও যেমন ব্যবধান করেছ পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে। হে আল্লাহ আমাকে আমার গুনাহ হতে এমনভাবে পবিত্র কর যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার হয়। হে আল্লাহ আমার গোনাহকে বরফ, পানি ও শিশির দ্বারা ধৌত করে দাও।’’ (মুসলিম ৫/২৭, হাঃ ৫৯৮, আহমাদ ৭১৬৭) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৭০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭০৮)
সূরায়ে ফাতিহা পাঠ
সানা পাঠ করার পর আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ করে সূরা ফাতিহা পুরা পড়তে হবে। পাঠ শেষে আমীন পড়তে হবে।
কিরাআত
সূরা ফাতিহা পাঠ করে আমীন বলার পর একটু চুপ থেকে (সাকতা করে) কুরআন থেকে তিলাওয়াত করতে হবে। যেকোনো সূরা বা নিয়ম অনুসারে সূরার কিছু অংশ পড়তে হবে। আসরের নামাজে জামাতে ইমাম ও মুক্তাদী সবাই প্রথম দুই রাকাতে সূরাহ ফাতিহার সঙ্গে আরও একটি সূরা তেলাওয়াত করবে, আর শেষের দুই রাকাতে শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ করলেই হবে।
রুকু করা
রুকুতে তিনি তাসবীহ তিন বা ততোধিক বার পাঠ করতে হবে, “সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম” ‘আমি আমার মহান প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।’
অথবা ‘‘সুবহানা যিল্ জাবারূতি ওয়াল মালাকূতি ওয়াল কিবরিয়াই ওয়াল ‘আযমাতি’’
“হে দুর্দান্ত প্রতাপশালী, রাজত্ব, অহংকার ও বড়ত্বের মালিক আল্লাহ! আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি।” (আবু দাউদ: ৮৭৩) যে ব্যক্তি রুকু ও সিজদা পরিপূর্ণভাবে আদায় করে না রাসূলুল্লাহ (স.) ঐ ব্যক্তিকে সালাত চোর বলে আখ্যায়িত করেছেন। (ইবনু আবী শাইবা- ১/৮৯/২)
কওমা (রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো)
রুকু থেকে উঠার পর সোজা হয়ে শান্তভাবে দাঁড়াতে হবে। এ সময় দু’হাত কিবলামুখী করে কাঁধ পর্যন্ত উঠিয়ে বলা হবে, “সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ” অর্থাৎ আল্লাহ সেই ব্যক্তির কথা শোনেন, যে তাঁর প্রশংসা করে। এরপর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ‘কওমা’র দো‘আ একবার পাঠ করতে হবে।
রুকূ থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় ইমাম, মুক্তাদি ও একাকী সালাত আদায়কারী সকলেই বলবে, রাব্বানা লাকাল হামদ , “হে আমাদের রব! তোমারই জন্য সকল প্রশংসা।” (সহিহ বুখারী: ৭৪৫)।
অথবা, রব্বানা ওয়া লাকাল হামদু, হামদান কাছীরান ত্বায়্যিবান মুবা-রাকান ফীহি। “হে আমাদের রব! তোমারই জন্য অধিক বরকতময় ও উত্তম প্রশংসা।” (বুখারী: ৭৯৯, ইফা ৭৬৩, আধুনিক ৭৫৫)
সিজদা (মাথা নত করা)
সিজদায় রাসূল (স) সিজদায় তাসবীহটি পড়েছেন, সুবহা–না রব্বিয়াল আ‘লা – “আমি আমার সুউচ্চ মহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”
সিজদা অবস্থায় বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হন। তাই রাসূলুল্লাহ (স.) সে সময় বেশি বেশি দু’আ করতে বলেছেন (মুসলিম: ৪৮২)। রাসূলুল্লাহ (স.) বহু ধরনের দু’আ করতেন। তন্মধ্যে নিয়ে একটি দু’আ উল্লেখ করা হলো:
“আল্লাহু-ম্মাগফির লী যাম্বী কুল্লাহু; দিক্কাহু ওয়া জিল্লাহু, ওয়া আউয়ালাহু ওয়া ‘আখিরাহু, ওয়া ‘আলানিয়্যাতাহু ওয়া সিররাহু“
“হে আল্লাহ! আমার সব গোনাহ তুমি ক্ষমা করে দাও, হোক তা ছোট বা বড়, আগের বা পরের, প্রকাশ্য বা গোপন ।” (মুসলিম: ৪৮৩)
দুই সিজদার মধ্যবর্তী বৈঠক
সিজদার থেকে উঠে বসা পর অর্থাৎ দুই সিজদার মধ্যবর্তী সময়ের বৈঠকে আল্লাহর রাসূল (স) নিম্নবর্ণিত দুআ পড়তেন,
আল্লা–হুম্মাগফির লী, ওয়ারহামনী, ওয়াহদিনী, ওয়াজবুরনী, ওয়া‘আফিনি, ওয়ারযুক্বনী, ওয়ারফা‘নী
“হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমার প্রতি রহম কর, আমাকে হেদায়াত দাও, আমাকে সুস্থ ও নিরাপদে রাখ এবং আমাকে রিযক দান কর।” (আবু দাউদ: ৮৫০)।
প্রথম বৈঠক
দুই রাকাত পড়ার পর বৈঠক করতে হবে। বৈঠকে ‘আত্তাহিইয়া-তু’ পড়ার পরে দরূদ, দো’আয়ে মাছূরাহ ও সম্ভব হলে বেশি বেশি করে অন্য দোয়া পড়বে। এর পর উঠে দাড়াবে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত পরে শেষ বৈঠকে বসতে হবে।
নামাজ পড়ার নিয়মঃ বিস্তারিত পড়ুন এখানে ক্লিক করে।
শেষ বৈঠক
শেষ বৈঠকে পড়তে হবে।
১. তাশাহ্হুদ (আত্তাহিইয়া-তু)
২. দরূদ
৩.দো’আয়ে মাছূরাহ
৪.তাশাহুদ ও সালামের মধ্যেকার দো’আ সমূহের শেষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আরও কিছু দো’আ পড়তেন ।
সালাম ফিরানো
অতঃপর ডানে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে দান দিকে মুখ ঘুড়াবে এরপর বামে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে মুখ ফিরিয়ে নামাজ সমাপ্ত করবে।
আসরের নামাজের পর দোয়া
নামাজের পর রাসুল্লাল্লাহ (সা:) অনেক দোয়া পড়তেন হাদিসের আলোকে সংক্ষিপ্ত কিছু দোয়া দেয়া হলো-
১. আল্লা-হু আকবার (একবার সরবে)
২. আস্তাগফিরুল্লাহ (৩ বার)
৩. আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালা-মু অমিন্কাস সালা-মু তাবা-রাকতা ইয়া যাল জালা-লি অল ইকরা-ম।
৪. লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু লা শারীকা লাহ্, লাহুল মুলকু অলাহুলহামদু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
৫. লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর; লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ (উচ্চস্বরে)। (মিশকাত হা/৯৬৩)
৬. আল্লা-হুম্মা লা মা-নিয়া লিমা আ’ত্বাইতা, অলা মু’তিয়া লিমা মানা’তা অলা য়্যানফাউযাল জাদ্দি মিনকাল জাদু। (মিশকাত হা/৯৬৩)
৭. সুবহা-নাল্লাহ্ ৩৩ বার, আলহামদু লিল্লা-হ্ ৩৩ বার, আল্লা-হু আকবার ৩৩ বার।
৮. সুরা ইখলাস,ফালাক্ব ও নাস ১ বার করে। (আবু দাঊদ২/৮৬, সহীহ তিরমিযী ১/৮, নাসাঈ ৩/৬৮)
৯. আয়াতুল কুরসী ১বার। প্রত্যেক নামাযের পর এই আয়াত পাঠ করলে মৃত্যু ছাড়া জান্নাত যাওয়ার পথে পাঠকারীর জন্য আর কোন বাধা থাকে না। (সহীহ জামে’ ৫/৩৩৯, সি: সহীহাহ্ ৯৭২)
একাকী দু’হাত তুলে দো’আ
সালাতের বাইরে যে কোন সময়ে বান্দা তার প্রভুর নিকটে যে কোন ভাষায় দো’আ করবে। বান্দা হাত তুলে একাকী নিরিবিলি কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহ তার হাত খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। (আবু দাউদ, মিশকাত হা/২২৪৪)
আসরের নামাজের ভুল ও সতর্কতা
- নামাজের ওয়াক্ত দেরিতে পড়া
- মনোযোগ হারিয়ে নামাজ আদায় করা
আসরের নামাজে মনোযোগ ধরে রাখার উপায়
- নামাজের আগে দুনিয়ার চিন্তা দূরে রাখুন
- কুরআনের অর্থ নিয়ে ভাবুন
- নামাজের প্রতিটি ধাপে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের অনুভূতি রাখুন
আসরের নামাজ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: আসরের নামাজ কত রাকাত?
উত্তর: ৪ রাকাত ফরজ।
প্রশ্ন: আসরের নামাজের নিয়ম কী?
উত্তর: উপরে বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে।
প্রশ্ন: আসরের পর কোন সূরা পড়তে হয়?
উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো সূরা বাধ্যতামূলক নয়। তবে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়া উত্তম।
প্রশ্ন: আসরের ৪ রাকাত সুন্নত কি?
উত্তর: হ্যাঁ, ফরজের আগে ৪ রাকাত সুন্নাত গায়রে মুয়াক্কাদাহ পড়া যায়। এতে ফজিলত আছে, না পড়লে গুনাহ হয় না।




