ফজরের নামাজ হলো ইসলামের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের প্রথম নামাজ, যা ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলা আদায় করা হয়। এটি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নামাজগুলোর একটি। কুরআন ও সহীহ হাদীসে এই নামাজের অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
এই নামাজে প্রথমে সুন্নত নামাজ পড়তে হয়, তারপর ফরজ নামাজ পড়তে হয়। নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-
ফজরের নামাজের রাকাত সংখ্যা
এই নামাজের মোট রাকাত সংখ্যা চার এর মধ্যে দুই রাকাত সুন্নত এবং দুই রাকাত ফরজ।
ফজরের নামাজের সময়
সুবহে সাদেক উদিত হলে এই নামাযের সময় শুরু হয় এবং শেষ হয় সূর্যোদয় পর্যন্ত। তবে এই নামাজ খুব ভোরে আদায় করাই উত্তম।
নিয়ত
যেকোন আমলের জন্য নিয়ত খুবই জরুরী। নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদত বা আমল শুদ্ধ হয় না। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক আমলসমূহ তো নিয়তের উপরেই নির্ভরশীল।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১নং)
নামাজের নিয়ত মানে হলো কোনো নির্দিষ্ট নামাজের জন্য দৃঢ় সংকল্প করা। এটি মনে মনে বলা অথবা মনে মনে স্থির করা যায়, যা নামাজকে শুদ্ধ করার জন্য অপরিহার্য। নির্দিষ্ট নামাজের জন্য (যেমন ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব, এশা,সুন্নত, নফল) মনে মনে সেই নামাজের নাম, রাকাত সংখ্যা এবং ফরয, সুন্নাত, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, ইত্যাদি উল্লেখ করতে হয়।
ফজরের নামাজের নিয়ত
সুন্নত নামাজের নিয়ত
“আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেবলার দিকে দাড়িয়ে ফজরের ২ রাকআত সুন্নত সালাতের জন্য প্রস্তুত হলাম নামাজ শুরু করলাম”এরপর তাকবীরে তাহরিমা “আল্লাহু আকবর” বলে নামাজ শুরু করতে হবে। (নিজের মত করে মনে মনে বলতে পারেন।)
ফরজ নামাজের নিয়ত
“আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেবলার দিকে দাড়িয়ে ফজরের ২ রাকআত ফরজ সালাতের জন্য প্রস্তুত হলাম নামাজ শুরু করলাম ” এরপর তাকবীরে তাহরিমা “আল্লাহু আকবর” বলে নামাজ শুরু করতে হবে। (নিজের মত করে মনে মনে বলতে পারেন।)
ফজরের নামাজের নিয়ম
সুন্নত পড়ার নিয়ম
নীচে একদম সংক্ষিপ্তভাবে নিয়ম দেয়া হলোঃ
১️। নিয়ত করে তাকবীর বলুন এরপর ছানা পড়ুন
২️। সুরা ফাতিহা পড়ুন
৩️। এরপর যেকোনো সূরা পড়ুন বা নিয়ম অনুসারে সূরার কিছু অংশ পড়ুন
৪️। রুকু, সেজদা সম্পন্ন করুন
৫️। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়ে নামাজ শেষ করুন।
ফরজ পড়ার নিয়ম
সুন্নতের মতোই পদ্ধতি, একাকী হলে আকামত দিয়ে ফরজ নিয়ত করে পড়তে হবে।
১️। তাকবীর বলুন এরপর ছানা পড়ুন
২️। সুরা ফাতিহা পড়ুন
৩️। এরপর যেকোনো সূরা পড়ুন বা নিয়ম অনুসারে সূরার কিছু অংশ পড়ুন
৪️। রুকু, সেজদা সম্পন্ন করুন
৫️। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পড়ে নামাজ শেষ করুন।
নামাজ পড়ার নিয়মঃ বিস্তারিত পড়ুন এখানে ক্লিক করে।
ফজরের নামাজের পর দোয়া
নামাজের পর রাসুল্লাল্লাহ (সা:) অনেক দোয়া পড়তেন হাদিসের আলোকে সংক্ষিপ্ত কিছু দোয়া দেয়া হল-
১। আল্লাহু আকবার (উচ্চস্বরে একবার)
২। আস্তাগফিরুল্লাহ্, ৩ বার।
৩। আল্লা-হুম্মা আন্তাস সালা-মু অমিন্কাস সালা-মু তাবা-রাকতা ইয়া যাল জালা-লি অল ইকরা-ম।
অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি শান্তি (সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র) এবং তোমার নিকট থেকেই শান্তি। তুমি বরকতময় হে মহিমময়, মহানুভব! (মুসলিম ১/৪১৪)
৪। لاَ إِلهَ إِلاَّ الله وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَ هُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ:- “ লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহু লা শারীকা লাহ্, লাহুল মুলকু অলাহুলহামদু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ:- আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই, সমস্ত রাজত্ব তাঁরই জন্য , সমস্ত প্রশংসা তাঁরই জন্য এবং তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।
৫। اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الَجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা লা মা-নিয়া লিমা আ’ত্বাইতা, অলা মু’তিয়া লিমা মানা’তা অলা য়্যানফাউযাল জাদ্দি মিনকাল জাউঊ।
অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি যা দান কর তা রোধ করার এবং যা রোধ কর তা দান করার সাধ্য কারো নেই। আর ধনবানের ধন তোমার আযাব থেকে মুক্তি পেতে কোন উপকারে আসবে না। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ , মিশকাত ৯৬২ নং)
৬। সুবহা-নাল্লাহ্ ৩৩ বার, আলহামদু লিল্লা-হ্ ৩৩ বার, আল্লা-হু আকবার ৩৩ বার।
আর ১০০ পূরণ করার জন্য উপরোক্ত ৪নং দুআ একবার পঠনীয়। এগুলি পাঠ করলে সমুদ্ররের ফেনা বরাবর পাপ হলেও মাফ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ ১/৪১৮, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৭১)
‘আল্লাহু আকবার’ ৩৪ বারও পড়া যায়। (মুসলিম, সহীহ ১৩৭৭নং)
৭। সুরা ইখলাস,ফালাক্ব ও নাস ১ বার করে। (আবু দাঊদ২/৮৬, সহীহ তিরমিযী ১/৮, নাসাঈ ৩/৬৮) ফজরের জন্য ৩ বারের কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়।
৮. আয়াতুল কুরসী ১বার। প্রত্যেক নামাযের পর এই আয়াত পাঠ করলে মৃত্যু ছাড়া জান্নাত যাওয়ার পথে পাঠকারীর জন্য আর কোন বাধা থাকে না। (সহীহ জামে’ ৫/৩৩৯, সি: সহীহাহ্ ৯৭২)
ফরজ নামাজের পর দোয়াসমূহঃ বিস্তারিত পড়ুন এখানে ক্লিক করে।
ফজরের নামাজের নফল
ফজরের ফরজ নামাজের পর সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত নফল নামাজ পড়া নিষেধ। এই সময়কালে শুধুমাত্র দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়া যায়, অন্য কোনো নফল নামাজ পড়া মাকরুহ (নিষিদ্ধ)। সূর্যোদয়ের পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ‘ইশরাক’ নামক নফল নামাজ পড়তে হয়।
ফজরের নামাজের গুরুত্ব
ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত নামাজ দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা অপেক্ষা উত্তম। এই নামাজ দিয়ে দিন শুরু করলে আল্লাহ্ তায়ালা পুরো দিনকেই বরকতময় করে দিবেন। মহান আল্লাহ্ তায়ালার পৃথিবী পরিচালনার মূল-নীতিই হচ্ছে ফজর দিয়ে দিন শুরু করা। তাই ফজরের সালাতের গুরুত্ব অনেক।
ফজরের নামাজের ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন এশা ও ফজর সালাতে কি কি ফযীলত রয়েছে মানুষ যদি তা জানত তবে উক্ত সালাতে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও ফজরের সালাতে উপস্থিত হত।
সহীহ মুসলিমে এসেছে “ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত নামাজ দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তা অপেক্ষা উত্তম।” এই ফযীলত তো শুধু দু’রাকাত সুন্নাতে তাহলে ফরয সালাতের ফযীলত কী হতে পারে? নিশ্চয় সুন্নাতের চেয়ে ফরজের সাওয়াব অনেক বেশি ও উত্তম। এ সমস্ত হাদীস ফজর সালাতের বিরাট প্রতিদান ও গুরুত্বের দলীল।
অতএব, প্রিয় মুসলিম ভাই! অলসতা করে এত অধিক নেকী-সাওয়াব নষ্ট করবেন না বরং ঐ সমস্ত মাধ্যম অবলম্বন করুন যা আপনাকে আল্লাহর হুকুমে ফজর সালাতের জন্য জাগিয়ে দিবে।
ফজরের নামাজ সংক্রান্ত হাদিস
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “এশা ও ফজর সালাতে যে ফযীলত রয়েছে মানুষ যদি তা জানত তবে তাহলে উক্ত সালাতে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও উপস্থিত হত।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
অন্য বর্ণনায় এসেছে “যে ব্যক্তি এশার নামায জামা‘আতে আদায় করল, সে যেন রাত্রির অর্ধাংশ ইবাদতে লিপ্ত থাকল এবং যে ফজরের নামায জামা‘আতে আদায় করল সে যেন পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায় করল।” (সহীহ মুসলিম) এবং তিনি (সাঃ) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মার অন্তর্ভুক্ত হল।” (সহীহ মুসলিম)
আরেক হাদিসে “ফজরের (সুন্নাত) দু’রাকাত সালাত দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা অপেক্ষা উত্তম।” (সহীহ মুসলিম)
সাধারণ ভুল ও সতর্কতা
- ফজরের নামাজ দেরিতে পড়া।
- দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া।
- নামাজে অমণযোগী হওয়া।
- অলসতা করে সুয়ে থাকা।
- নিয়ত না করা।
- সূর্য ওঠার পর নামাজ পড়ে ফেলা।
নামাজে মনোযোগ ধরে রাখার উপায়
- নামাজের আগে সুন্দর করে অযু করুন
- অযু করার সময় দোয়া পড়ুন
- মনে রাখুন, ফজর হলো আল্লাহর সাথে আপনার প্রথম সংলাপ
- নামাজের সময় দুনিয়ার চিন্তা দূরে রাখুন
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং অবশ্যই কুরআন ও সহিহ হাদিস অনুসারে নির্ভরযজ্ঞ আলেমের মতামত অনুযায়ী আমল করবেন।
সূত্রঃ হাদিসবিডি.কম ও অন্যান্য সূত্র থেকে সংগ্রহীত।
ফজরের নামাজ সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. ফজরের নামাজ আগে সুন্নত নাকি ফরজ?
সুন্নত আগে, তারপর ফরজ পড়তে হয়।
২. ফজরের কাজা নামাজ কিভাবে পরবো?
অনান্য কাজা নামাজের মত আদায় করুন। বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ নিন।
৩. ফজরের কাজা নামাজ কখন পরবো?
সূর্য ওঠার প্রায় ১৫ মিনিট পর থেকে পড়া যায়। বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ নিন।
৪. ফজরের নামাজের শেষ সময় কখন?
সূর্য ওঠার পূর্ব পর্যন্ত।
৫. ফজরের নামাজে কোন সূরা পড়তে হয়?
এই নামাজে নির্দিষ্ট কোনো সূরা নেই, তবে নবীজি (সাঃ) বিভিন্ন সূরা তেলাওয়াত করতেন। তিনি প্রায়শই ষাট থেকে একশ আয়াত পর্যন্ত দীর্ঘ তিলাওয়াত করতেন এবং সুরা কাফ, রূম, তাকভির,স্বা-ফফাত, যিলযাল,মু’মিনূন এবং তূর উল্লেখযোগ্য।
৬. মহিলাদের নামাজ কিভাবে পড়তে হয় ?
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন তোমরা সেভাবে সালাত আদায় কর যেভাবে আমাকে আদায় করতে দেখো। সুতরাং পুরুষ মহিলা উভয়ের জন্য সালাত একইরকম। বিস্তারিত জানতে বিজ্ঞ আলেমের পরামর্শ নিন।
৭. ফজরের নামাজ কখন পড়া উত্তম?
খুব ভোরে পড়া উত্তম।
৮. ফজরের নামাজ না পড়লে কী হবে?
ইচ্ছাকৃতভাবে ফজরের নামাজ না পড়লে বড় গুনাহ হবে, কারণ এটি একটি ফরজ ইবাদত।




