ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে নেতৃত্বের ধারণা কেবল ক্ষমতার চর্চা নয়, বরং আল্লাহর প্রতি দায়িত্বশীলতা ও মানবতার সেবার অঙ্গীকার। ইসলামী নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হলো দর্শন (তাওহীদ-ভিত্তিক বিশ্বাস), ঐক্য (উম্মাহর একতা) এবং ধারাবাহিকতা (নবী-রাসূলদের পদাঙ্ক অনুসরণ)। এই তিন স্তম্ভ ছাড়া ইসলামী নেতৃত্বের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। চলুন জেনে নেই ইসলামী নেতৃত্বের দর্শন ও ঐক্য-
ইসলামী নেতৃত্বের দর্শন: তাওহীদ-কেন্দ্রিক বিশ্বদৃষ্টি
ইসলামে নেতৃত্বের মূল দর্শন তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব)। ইসলামী নেতৃত্বে দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতা হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি, যিনি কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“তোমাদের প্রত্যেকেই রক্ষক বা (আমানতদার), এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।” (সহিহ বুখারি-৬৬৫৩)
মূলনীতি:
আমানতদারিত্ব: নেতা জনগণের আমানত রক্ষা করবেন।
আদল (ন্যায়বিচার): সবার প্রতি ন্যায়পরায়ণ হওয়া।
শুরা (পরামর্শ): গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উম্মাহর সাথে আলোচনা।
ইখলাস (আন্তরিকতা): ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার।
ঐক্য: উম্মাহর অস্তিত্বের মেরুদণ্ড
ইসলামী নেতৃত্বের দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো ঐক্য। কুরআন ঘোষণা করে:
“আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তকরে আকড়ে ধর এবং বিভক্ত হইয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
ঐক্যের গুরুত্ব:
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ: সহীহ মুসলিম (হাদিস: ১৮৫২)-এ একটি দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন: যখন সবাই একসাথে কাজ করে এবং একই নেতাকে অনুসরণ করে, আর কেউ এসে তোমাদের জামা’আতকে বিভক্ত করতে অথবা তোমাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে চায়, তখন তোমরা তাকে হত্যা করো। মূলত, ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং কাউকে আমাদের বিভক্ত বা সমস্যা সৃষ্টি করতে না দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি: ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ বহিরাক্রমণ ও সংকট মোকাবিলায় সক্ষম।
দাওয়াতের সাফল্য: ঐক্যই ইসলামের বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার মূল চাবিকাঠি।
চ্যালেঞ্জ: আজ রাজনৈতিক, জাতিগত ও মাজহাবি বিভেদ উম্মাহকে দুর্বল করছে। ইসলামী নেতৃত্বকে এই বিভেদ দূর করে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ধারাবাহিকতা: নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকার
ইসলামী নেতৃত্বের তৃতীয় স্তম্ভ ধারাবাহিকতা। এটি নবী আদম (আ.) থেকে রাসূল মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এবং খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত।
ধারাবাহিকতার মূলভিত্তি:
কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণ: নেতাকে অবশ্যই শরীয়তের আলোকে পরিচালিত হতে হবে।
ইলম (জ্ঞান) ও তাকওয়া (ধর্মভীরুতা): নেতা হতে হবে আলেম ও আল্লাহভীরু।
উম্মাহর সেবা: নবী (সা.) বলেছেন, “তোমাদের শ্রেষ্ঠ নেতা সে, যে তোমাদের সেবা করে।” (মুসলিম)
আধুনিক প্রেক্ষাপট: আজ অনেকে ইসলামী নেতৃত্বকে রাজনৈতিক দলের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। প্রকৃত ইসলামী নেতৃত্ব হবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যা নবী-রাসূলদের আদর্শে অবিচল থেকে উম্মাহর ঐক্য ও কল্যাণে নিবেদিত।
একটি শক্তিশালী ইসলামী জীবনব্যবস্থার ভিত্তি তিনটি: নীতিভিত্তিক নেতৃত্ব, জনগণের ঐক্য এবং আদর্শের ধারাবাহিকতা। নেতৃত্বকে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হতে হবে, যেখানে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর এমন নেতার প্রয়োজন, যিনি নবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সকলকে একতার রজ্জুতে বাঁধবেন। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। (আমিন)