সূরা ফালাক পবিত্র কুরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা আমাদের সব ধরনের অনিষ্ট, জাদু ও হিংসা থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দেয়। এটি এবং এর পরবর্তী সূরা আন-নাসকে একত্রে “মুআওয়িযাতাইন” (আশ্রয় বা সুরক্ষার সূরা) বলা হয়। এই নির্দেশিকাটিতে আমরা সূরা ফালাকের বাংলা উচ্চারণ, বিশুদ্ধ আরবি পাঠ, অর্থ, তাফসীর এবং এর অসাধারণ ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
সূরা ফালাক পরিচিতি
সূরার নামকরণ
এই সূরার প্রথম আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ “আল-ফালাক” (اَلْفَلَقْ) থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো “ঊষা” বা “প্রভাত”। এই শব্দ দ্বারা এমন সব সৃষ্টিকে বোঝানো হয়েছে যা অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এসেছে এবং আল্লাহ্ যাকে উন্মুক্ত করেন।
কত নম্বর সূরা ও কোথায় নাজিল হয়েছে
- সূরার ক্রম: এটি পবিত্র কুরআনের ১১৩ নম্বর সূরা।
- নাজিলের স্থান: বেশিরভাগ মুফাসসিরদের মতে এটি মাক্কী সূরা (মক্কায় অবতীর্ণ), যদিও কেউ কেউ একে মাদানী (মদীনায় অবতীর্ণ) বলেছেন।
মাদানী নাকি মাক্কী সূরা?
অধিকাংশ মত অনুসারে, এটি মাক্কী সূরা। তবে, এর শানে নুযুল (নাজিলের প্রেক্ষাপট) মদীনার একটি ঘটনাকে নির্দেশ করে, যে কারণে কেউ কেউ একে মাদানীও বলে থাকেন। সুরক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে দ্রুত আশ্রয় চাওয়ার গুরুত্বের কারণে এটি মাক্কী বা মাদানী যে কোনো পরিস্থিতিতেই সমানভাবে কার্যকর।
সূরা ফালাকের নাজিলের প্রেক্ষাপট (শানে নুযুল)
জাদু ও শত্রুর অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য নাজিল
সহীহ হাদিস ও তাফসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, একবার মদীনার জনৈক ইহুদি লাবীদ ইবনে আসাম এবং তার কন্যারা মহানবী (সা.)-এর প্রতি জাদু করেছিল। এর ফলে রাসূল (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছু বিষয় ভুলে যেতে শুরু করেন।
লাবীদ ইবনে আসামের ঘটনা (সংক্ষেপে)
রাসূল (সা.)-এর এই অসুস্থতার সময় আল্লাহ্ তাআলা জিবরাইল (আ.)-কে পাঠিয়ে এই সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাজিল করেন। জিবরাইল (আ.) রাসূল (সা.)-কে জানান যে লাবীদ ইবনে আসাম একটি কুয়োর মধ্যে খেজুরের কাঁদি ও রাসূল (সা.)-এর মাথার চুলকে একত্রিত করে তাতে জাদু করে রেখেছে। রাসূল (সা.) লোক পাঠিয়ে সে স্থান থেকে জাদুর সরঞ্জাম উদ্ধার করান। এরপর প্রতিটি আয়াতে পাঠ করার সাথে সাথে একটি করে গিট বা বাঁধন খুলে যেতে থাকে। ফলে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এই সূরাটি যাদু, অনিষ্ট ও হিংসা থেকে সুরক্ষার জন্য এক অব্যর্থ আমল।
সূরা ফালাকের আরবি
بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
১. قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
২. مِن شَرِّ مَا خَلَقَ
৩. وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
৪. وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
৫. وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
সূরা ফালাকের বাংলা উচ্চারণ
সূরা ফালাকের বাংলা উচ্চারণ) ধারণ করে:
১. কুল আউযু বিরব্বিল ফালাক্ব।
২.মিন শাররি মা-খালাক্ব।
৩.ওয়া মিন শাররি গ-সিক্বিন ইযা-ওয়াক্বাব।
৪. ওয়া মিন শাররিন নাফ্ফা-সা-তি ফিল ‘উক্বাদ।
৫. ওয়া মিন শাররি হা-সিদিন ইযা-হাসাদ।
(বিশুদ্ধ মাখরাজ (উচ্চারণ স্থান) অনুযায়ী সঠিক উচ্চারণের জন্য একজন অভিজ্ঞ ক্বারীর কাছ থেকে শিখে নেওয়া আবশ্যক।)
সূরা ফালাকের বাংলা অর্থ
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
১. বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রভুর নিকট,
২. তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
৩. অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
৪. গ্রন্থিতে (গিঁটে) ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে,
৫. এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
আয়াত- ভিত্তিক তাফসীর
প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা
১. قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক্ব)
অর্থ: বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রভুর নিকট।
আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রিয় নবী (সা.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে তিনি যেন ‘রব্বুল ফালাক্ব’ (ঊষার প্রতিপালক)-এর কাছে আশ্রয় চান। ‘ফালাক্ব’ শব্দটি প্রভাত বা সকালের উন্মোচনকে নির্দেশ করে, যা মহাজাগতিক এক পরিবর্তন। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ ইঙ্গিত দেন যে যিনি রাতের অন্ধকার চিরে দিনের আলো আনতে পারেন, তিনি যেকোনো অন্ধকার বা অনিষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখেন।
দ্বিতীয় আয়াত- সকল সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয়
২. مِن شَرِّ مَا خَلَقَ (মিন শাররি মা-খালাক্ব)
অর্থ: তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,
এই আয়াতে আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টিকুলের ‘শার’ বা অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি শয়তান, জিন, মানুষ, ক্ষতিকর প্রাণী—সব ধরনের বাহ্যিক ও অদৃশ্য ক্ষতিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
তৃতীয় আয়াত- অন্ধকারের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা
৩. وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ (ওয়া মিন শাররি গ-সিক্বিন ইযা-ওয়াক্বাব)
অর্থ: অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,
‘গাসিক্ব’ অর্থ অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রি, আর ‘ওয়াক্বাব’ অর্থ যখন তা প্রবেশ করে বা ছেয়ে যায়। রাতের গভীর অন্ধকারে খারাপ কাজ, অনিষ্টকারী প্রাণী, শয়তানি শক্তি এবং ভয়ংকর বিপদাপদ সহজে ঘটে থাকে। তাই বিশেষ করে রাতের সময়ের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।
চতুর্থ আয়াত- যাদুকরদের ফুঁ দেওয়ার অনিষ্ট
৪. وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ (ওয়া মিন শাররিন নাফ্ফা-সা-তি ফিল ‘উক্বাদ)
অর্থ: গ্রন্থিতে (গিঁটে) ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে,
এই আয়াতে জাদু ও কুফরী কার্যকলাপ থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। ‘নাফ্ফা-সা-ত’ হলো সেই নারীরা (যদিও এর পুরুষ প্রয়োগও আছে) যারা জাদুটোনা করার জন্য কোনো বস্তুর গিঁটে ফুঁ দেয়। এটি লাবীদ ইবনে আসামের ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এবং জাদুর অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার জন্য এটি কুরআনের সরাসরি নির্দেশনা।
পঞ্চম আয়াত- হিংসুকের হিংসা থেকে রক্ষা
৫. وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ (ওয়া মিন শাররি হা-সিদিন ইযা-হাসাদ)
অর্থ: এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
‘হাসাদ’ (হিংসুক) হলো সে, যে অন্যের নিয়ামত বা ভালো দেখে তা বিলুপ্তির কামনা করে। হিংসুকের হিংসা খুবই মারাত্মক, কারণ এটি বদনজর (কুনজর) এবং অন্যান্য নেতিবাচক শক্তি সৃষ্টি করে। এই আয়াতটি ইঙ্গিত দেয় যে হিংসা একটি বাস্তব বিপদ, এবং এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর আশ্রয় কামনা করা।
সূরা ফালাকের মূল শিক্ষা
আল্লাহই একমাত্র অভিভাবক ও রক্ষাকারী
এই সূরার মূল শিক্ষা হলো- সকল অনিষ্ট, তা যত সূক্ষ্ম বা ভয়ঙ্করই হোক না কেন, তা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্ই একমাত্র অভিভাবক এবং রক্ষাকারী (আল-হাফীজ)। অন্য কোনো তন্ত্র-মন্ত্র বা মানুষের ক্ষমতা এসব অনিষ্ট দূর করতে পারে না।
অদৃশ্য অনিষ্ট থেকে সুরক্ষার কুরআনী দিকনির্দেশনা
সূরা ফালাক বিশেষভাবে সেইসব অদৃশ্য এবং অপ্রত্যক্ষ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দেয়, যেমন: যাদু, গভীর রাতের ভয়, বদনজর ও হিংসা।
ঈমান ও ভরসার শিক্ষা
এই সূরাটি মুমিনদের মনে আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও ভরসার (তাওয়াক্কুল) জন্ম দেয়। এটি শেখায় যে, বিপদ যত বড়ই হোক না কেন, আল্লাহ্র আশ্রয় সর্বদা মজবুত।
সূরা ফালাকের ফজিলত ও উপকারিতা
কষ্ট, ভয় ও অনিষ্ট দূর করার সেরা সূরা
রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সূরাটির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এই সূরাদ্বয়ের (ফালাক ও নাস) মতো কোনো সূরা তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর এমনকি কুরআনেও অনুরূপ অন্য কোনো সূরা নাজিল হয়নি।
রাসূল (সা.) এর দৈনন্দিন আমলে সূরা ফালাক
হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) কোনো রোগে আক্রান্ত হলে বা কোনো কষ্টে পড়লে এই সূরাদ্বয় এবং সূরা ইখলাস পাঠ করে তাঁর হাতে ফুঁ দিয়ে সারা শরীরে বুলিয়ে নিতেন। এটি তাঁর নিত্যদিনের আমল ছিল।
ঘুমের আগে পড়ার গুরুত্ব
প্রতি রাতে ঘুমানোর পূর্বে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে দুই হাতে ফুঁ দিয়ে সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটি ঘুমন্ত অবস্থায় সকল অনিষ্ট থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
রোগ, জাদু, বদনজর থেকে রক্ষা
এই সূরাদ্বয় যাদু, বদনজর ও দুষ্ট আত্মার অনিষ্ট দূর করার জন্য রুকইয়াহ (শরীয়াহসম্মত ঝাড়-ফুঁক) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের রোগ বা কষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে সুরক্ষার শক্তিশালী মাধ্যম।
সূরা ফালাক কখন এবং কীভাবে পড়তে হয়
নামাজে পড়ার নিয়ম
অন্যান্য ছোট সূরার মতোই, সূরা ফালাক ফরয ও নফল সকল প্রকার নামাজের শেষ দুই রাকাতে সূরা ফাতিহার পরে পড়া যায়।
রুকইয়াহর (Ruqyah) অংশ হিসেবে পাঠ
জাদু, বদনজর বা জিন-এর প্রভাব দূর করার জন্য এই সূরাটি (এবং মুআওয়িযাতাইন) পাঠ করে ফুঁক দেওয়া ।
দৈনন্দিন সুরক্ষা হিসাবে পাঠ
- প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায়: ফজর ও মাগরিবের নামাজের পরে পাঠ করা সুন্নত।
- প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরে: প্রতি ওয়াক্ত ফরয নামাজের পরে একবার করে পাঠ করা উচিত।
- ঘুমানোর পূর্বে: রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আমল।
সূরা ফালাক সম্পর্কিত হাদিস
মুআওয়িযাতাইন পাঠের গুরুত্ব
১. আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অসুস্থ হতেন, তখন তিনি নিজেই সূরা আল-মু‘আউইযাত (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) পড়ে নিজের উপর ফুঁ দিতেন। তবে অসুস্থতা যখন তীব্র হয়ে গেল এবং নিজে তা করতে কষ্ট হত, তখন আয়িশা (রাঃ) তাঁর পক্ষ থেকে ওই সূরাগুলো পড়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর শরীরে নিজের হাত বুলিয়ে দিতেন বরকতের উদ্দেশ্যে।
সহীহ বুখারী
ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৫১
আন্তর্জাতিক নম্বরঃ ৫০১৬
২. উকবা ইবন আমির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নির্দেশ দেন—
প্রতিটি সালাতের পর সূরা ফালাক ও সূরা নাস (মু’আওয়্বিযাতায়ন) পাঠ করতে।
এটি তাঁর নিয়মিত আমল ছিল এবং সাহাবীগণকে তা অনুসরণের নির্দেশ দিতেন।
- সহীহাহ: ১৫১৪
- সহীহ আবু দাউদ: ১৩৬৩
- তা’লীক ‘আলা ইবনে খুযাইমাহ: ৭৫৫
- তিরমিজী: ২৯০৩ (আল মাদানী প্রকাশনী)
ঘুমানোর আগে সূরা ফালাক + সূরা নাস পড়ার নির্দেশ
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন রাতের বেলা শয্যায় যাওয়ার আগে তিনটি সূরা—
সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস—পাঠ করতেন।
পাঠ শেষে তিনি দুই হাত একত্র করতেন, হাতের মধ্যে ফুঁ দিতেন, তারপর মাথা ও মুখ থেকে শরীরের সম্মুখভাগ পর্যন্ত হাত বুলাতেন।
এভাবে তিনবার করতেন।
সহীহ বুখারী
ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৪৬৫২
আন্তর্জাতিক নম্বর: ৫০১৭
শিশুদের জন্য সূরা ফালাক শেখার কৌশল
ধীরে ধীরে উচ্চারণ শেখানো
শব্দ ভেঙে ভেঙে এবং মাখরাজের (উচ্চারণ স্থান) প্রতি জোর দিয়ে শিশুদের ধীরে ধীরে উচ্চারণ শেখানো উচিত। ভুল উচ্চারণে মুখস্থ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
অডিও–ভিডিও ব্যবহার
শুদ্ধ উচ্চারণের অডিও-ভিডিও টিউটোরিয়াল ব্যবহার করে শিশুদের শেখা অনেক সহজ ও আনন্দদায়ক হয়।
অর্থসহ বুঝিয়ে শেখানো
শুধুমাত্র মুখস্থ না করিয়ে, প্রতিটি আয়াতের সরল অর্থ এবং আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চাওয়ার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিলে শিশুরা সূরার প্রতি আগ্রহী হবে।
সূরা ফালাক ও সূরা নাসের সম্পর্ক
উভয় সূরাকে একত্রে “মুআওয়িযাতাইন” বলা হয়
এই দুটি সূরার মূল বিষয়বস্তু হলো আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা (তা’আউয) করা। এই অভিন্ন উদ্দেশ্যর কারণে এদের একত্রে ‘মুআওয়িযাতাইন’ (দুটি আশ্রয়ের সূরা) বলা হয়।
সুরক্ষা ও রক্ষার জন্য যুগল সূরা
- সূরা ফালাক: বাহ্যিক ও জাগতিক বিপদ (সৃষ্টির অনিষ্ট, জাদু, হিংসা, অন্ধকার) থেকে আল্লাহর আশ্রয়।
- সূরা নাস: আভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক বিপদ (শয়তান, কু-মন্ত্রণা, মানুষের কুমন্ত্রণা) থেকে আল্লাহর আশ্রয়।
এই দুই সূরা একত্রে পাঠ করলে মুমিন সকল প্রকার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অনিষ্ট থেকে আল্লাহর মজবুত সুরক্ষার মধ্যে চলে আসে।
সূরা ফালাক পাঠের সাধারণ ভুল ও সংশোধন
উচ্চারণে প্রচলিত ভুল
| ভুল উচ্চারণ (সম্ভাব্য) | সঠিক উচ্চারণ | সংশোধনের দিকনির্দেশনা |
| কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক | কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক্ব | ق (ক্বাফ)-এর মাখরাজ জিহ্বার গোড়া থেকে। |
| মিন শাররি মা খালাক | মিন শাররি মা-খালাক্ব | خ (খা)-এর মাখরাজ ও ক্বাফ-এর উপর জোর দিতে হবে। |
| ওয়া মিন শাররি নাফফাসাত | ওয়া মিন শাররিন নাফ্ফা-সা-তি | ফ-এর উপর তাশদীদ ও দীর্ঘ টান (মদ) দিতে হবে। |
অর্থ ভুলভাবে প্রয়োগ
সূরা ফালাক শুধুমাত্র যাদু বা হিংসার জন্য নয়, বরং সব ধরনের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার জন্য। এর ব্যবহারকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয়।
পাঠে নিয়মিত ভুল এড়ানোর কৌশল
যেকোনো কোরআনি আমলের ক্ষেত্রে নিয়মিত অভিজ্ঞ ক্বারীর কাছে শেখা এবং বারবার আবৃত্তি করে ভুল সংশোধন করে নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সূরা ফালাকের শব্দভাণ্ডার বিশ্লেষণ
ফালাক শব্দের প্রকৃত অর্থ
ফালাক (اَلْفَلَقْ): এর আভিধানিক অর্থ ফাটল, বিদীর্ণ হওয়া, বা উন্মোচন হওয়া। সাধারণত এর অনুবাদ করা হয় “ঊষা” বা “প্রভাত”। এর ব্যাপক অর্থে, এমন সব সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত যা অস্তিত্বহীনতা থেকে ফাটল ধরে অস্তিত্ব লাভ করেছে।
শার (অনিষ্ট), গাসিক, নাফাসাত ব্যাখ্যা
- শার (شَرِّ): এর অর্থ অনিষ্ট, ক্ষতি, মন্দ, বা বিপদ।
- গাসিক (غَاسِقٍ): অর্থ অন্ধকারাচ্ছন্ন বা গভীর রাত।
- নাফ্ফা-সা-ত (النَّفَّاثَاتِ): ‘নাফস্’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ফুঁক দেওয়া। এটি মূলত গিঁটে ফুঁক দিয়ে জাদুকারী নারীদের বোঝায়।
সূরা ফালাক সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. সূরা ফালাকের বাংলা উচ্চারণ কী?
কুল আউযু বি-রাব্বিল ফালাক
মিন শাররি মা খালাক
ওয়া মিন শাররি গাসিকিন ইযা ওয়াকাব
ওয়া মিন শাররিন্নাফ্ফাছাতি ফিল উকাদ
ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইযা হাসাদ
২. “কুল আউযু বি-রাব্বিল ফালাক” এর অর্থ কী?
অর্থ: বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি প্রভাতের প্রভুর কাছে।
৩. আল-ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ কী?
ফালাক অর্থ:
- ভোর বা প্রভাত
- অন্ধকার ছেদ করে আলোর উদয়
- সৃষ্টির উদ্গম বা প্রকাশ
৪. “ওয়া মিন শাররি হাসিদিন ইযা হাসাদ” অর্থ কী?
অর্থ: এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
৫. সূরা ফালাক কত আয়াত?
সূরা ফালাক মোট ৫ আয়াত।
৬. সূরা ফালাকের তরজমা (বাংলা অনুবাদ) কী?
১. বলুন, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি প্রভাতের প্রভুর কাছে।
২. তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে।
৩. রাত্রির অন্ধকারের অনিষ্ট থেকে, যখন তা ঘন হয়ে আসে।
৪. গিঁটে ফুঁৎকার দেওয়ালাদের অনিষ্ট থেকে।
৫. এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
৭. সূরা ফালাক পড়লে কি হয়?
- জাদু, নজর, হিংসা, অশুভ শক্তি ও সকল ক্ষতি থেকে আল্লাহর বিশেষ সুরক্ষা পাওয়া যায়।
- রাতের আমল হিসেবে এটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিয়মিত সহীহ আমল।
- এটি রুকইয়ার অন্যতম প্রধান সূরা।
৮. মু‘আওয়্বিযাতাইন কী?
সূরা ফালাক ও সূরা নাস—এই দুটি সূরাকে একত্রে মু‘আওয়্বিযাতাইন বলা হয়।
অর্থ: “দুটি আশ্রয় প্রার্থনার সূরা।”
৯. ফালাক কী?
ফালাক হলো—প্রভাত, আলোর উদয়, অন্ধকার ছেদন, সৃষ্টির সূচনা।
১০. “الفلق” এর অর্থ কী?
অর্থ: ভোর, ভোরের আলো, ফাটল, উদ্গম।
১১. সূরা নাস ও ফালাক নাজিলের কারণ কী? (শানে নুযুল)
- রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর উপর লাবীদ ইবন আ’সাম নামের এক ইহুদী জাদু করেছিল।
- আল্লাহ এই দুই সূরার মাধ্যমে নবী ﷺ–কে পরিপূর্ণ শিফা ও সুরক্ষা দেন।
- তাই এগুলোকে বলা হয় রুকইয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা।
১২. সূরা আল-ফালাক এর নামকরণের কারণ কী?
এ সূরাতে আল্লাহকে “ফালাকের প্রভু”- অর্থাৎ ভোরের আলো উদ্ভাসিত করা প্রভু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাই নাম- আল-ফালাক।
১৩. সূরা ফালাকের বাংলা অর্থ কী?
“ভোর”, “আলোর উদয়”, অথবা “অন্ধকার ছেদন”।
১৪. সূরা আলা এর বাংলা অর্থ কী?
আল-আ’লা অর্থ: অতি মহান, সর্বোচ্চ, উচ্চ মর্যাদার।
১৫. আন-নাস নামের অর্থ কী?
আন-নাস অর্থ: মানবজাতি / মানুষসমূহ।
১৬. সূরা ফালাকের শানে নুযুল কী?
এ সূরা নাজিল হয়েছিল:
- জাদু, নজর, শয়তানের কুমন্ত্রণাসহ সব ধরনের অদৃশ্য অনিষ্ট থেকে রক্ষা দেওয়ার জন্য।
- নবী ﷺ–এর উপর হওয়া জাদুর প্রতিকার হিসেবে।
১৭. তিন কুল পড়ার ফজিলত কী?
- রাতে শোবার আগে পড়লে রাতে সুরক্ষা।
- সব ধরনের ক্ষতি, জাদু, নজর থেকে রক্ষা।
- নবী ﷺ–এর Sunnah রুকইয়া আমল।
- প্রতিটি সালাতের পরে পড়া খুবই ফযিলতপূর্ণ (সাহাবী বর্ণনা)।
১৮. ৩ কুল কি কি?
১. সূরা ইখলাস
২. সূরা ফালাক
৩. সূরা নাস
এগুলোকে বলা হয় “সুরক্ষার তিন সূরা” বা “তিন কুল”।




