১. টিআইএন সার্টিফিকেট কী?
টিআইএন বা ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর একটি অনন্য সনাক্তকারী সংখ্যা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এটি প্রদান করে। এই নম্বরটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কর দাতা হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়পত্র। আয়কর রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য। বর্তমানে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে এর নিবন্ধন সম্পন্ন হয়। এটিকে ই-টিআইএন বলা হয়। এই সার্টিফিকেট সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাকে সহজ করে। এটি একটি স্বচ্ছ কর ব্যবস্থাপনার অন্যতম হাতিয়ার।
২. টিআইএনের প্রয়োজনীয়তা কেন?
টিআইএন সার্টিফিকেটের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমত, এটি আইনগতভাবে কর পরিশোধের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হলে এটি আবশ্যক। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ঋণ গ্রহণ, সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি লাগে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে আবেদনের সময়ও এটি জমা দিতে হয়। এছাড়া, ব্যবসায়িক লাইসেন্স নবায়ন এবং টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য টিআইএন অপরিহার্য। এটি একজন নাগরিকের দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক। সুশাসন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এর ভূমিকা অপরিসীম।
৩. কাদের টিআইএন প্রয়োজন?
সবার জন্য টিআইএন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্যক্তিদের জন্য এটি আবশ্যক। যাদের বাৎসরিক আয় নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তাদের অবশ্যই টিআইএন থাকতে হবে। ব্যবসায়ী, পেশাজীবী এবং বেতনভোগী কর্মচারীরা এর আওতায় পড়েন। যারা কোনো সরকারি চুক্তি বা টেন্ডারে অংশ নিতে চান তাদেরও এটি লাগে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য এটি জরুরি। এছাড়া, যারা আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের ক্ষেত্রেও এটি অপরিহার্য। স্বেচ্ছায় কর দিতে ইচ্ছুক যে কেউ এটি নিতে পারেন।
৪. কিভাবে অনলাইনে ই-টিআইএন এর আবেদন করবেন?
অনলাইনে ই-টিআইএন নিবন্ধন প্রক্রিয়া খুবই সহজ ও ঝামেলাবিহীন। প্রথমে আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সেখান থেকে e-TIN Registration অপশনটি নির্বাচন করুন। এরপর আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং জন্ম তারিখ দিয়ে লগইন করতে হবে। সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার তথ্য যাচাই করবে। এরপর একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। ফর্মে আপনার ব্যক্তিগত ও আয়ের তথ্য দিতে হবে। সঠিকভাবে তথ্য দিয়ে ফর্মটি সাবমিট করুন। সাবমিট করার সাথে সাথেই আপনি একটি ১২ ডিজিটের ই-টিআইএন নম্বর পাবেন। এটি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নিন।
৫. আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
অনলাইনে ই-টিআইএন নিবন্ধনের জন্য খুব বেশি কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না। মূলত আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আবেদনের সময় আপনার NID কার্ডের নম্বর এবং জন্ম তারিখ লাগবে। এছাড়া, আপনার একটি সত্যায়িত ছবির প্রয়োজন হতে পারে। যদি আপনি কোম্পানির পক্ষে আবেদন করেন তবে কিছু অতিরিক্ত কাগজপত্র লাগবে। যেমন: কোম্পানির নিবন্ধনকরণ সনদ, ট্রেড লাইসেন্স এবং অনুমোদিত ব্যক্তির তথ্য। তবে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের জন্য শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র যথেষ্ট। সমস্ত তথ্য আপনার NID থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই হয়ে যায়।
৬. টিআইএন এবং ই-টিআইএন এর পার্থক্য
টিআইএন এবং ই-টিআইএন মূলত একই জিনিসের দুটি ভিন্ন রূপ। পূর্বে করদাতাদের ম্যানুয়ালি নিবন্ধনের মাধ্যমে টিআইএন সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। এটি ছিল একটি কাগজের সার্টিফিকেট। এর নম্বর ছিল ১০ ডিজিটের। অন্যদিকে, ই-টিআইএন হলো আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতি। এটি সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। ই-টিআইএন এর নম্বর ১২ ডিজিটের হয়ে থাকে। এটি তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় এবং এর কোনো খরচ নেই। বর্তমানে সরকার ই-টিআইএনকেই কার্যকর বলে গণ্য করে। পুরনো টিআইএন ধারকদেরও ই-টিআইএনে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
৭. টিআইএন সার্টিফিকেটের ব্যবহার
টিআইএন সার্টিফিকেটের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই প্রসারিত। এটি শুধু আয়কর দাখিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নিতে হলে টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দিতে হয়। কোনো সম্পত্তি, যেমন ফ্ল্যাট বা জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় এটি বাধ্যতামূলক। বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট করতে বা ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রেও এটি জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি উচ্চপদে চাকরির আবেদনে টিআইএন থাকা একটি যোগ্যতা। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন এবং বড় বড় টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্যও এটি প্রয়োজন। এটি একজন নাগরিকের আর্থিক স্বচ্ছতার প্রতীক।
প্রশ্ন ও উত্তর
১. প্রশ্ন: টিআইএন সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য কোনো ফি লাগে?
উত্তর: না, অনলাইনে ই-টিআইএন নিবন্ধনের জন্য কোনো ধরনের ফি বা খরচ প্রযোজ্য নয়। এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা যায়।
২. প্রশ্ন: আমার টিআইএন সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে, এখন কি করব?
উত্তর: চিন্তার কিছু নেই। আপনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার NID নম্বর দিয়ে সহজেই এটি আবার ডাউনলোড করতে পারবেন।
৩. প্রশ্ন: কি সব বেতনভোগী মানুষের টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, শুধুমাত্র যাদের বাৎসরিক আয় সরকার নির্ধারিত করমুক্ত সীমা অতিক্রম করে, শুধুমাত্র তাদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক।
৪. প্রশ্ন: ই-টিআইএন নম্বর কত ডিজিটের হয়?
উত্তর: ই-টিআইএন নম্বর মোট ১২ ডিজিটের হয়ে থাকে। এই নম্বরটি করদাতাকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করে।
৫. প্রশ্ন: একজন ব্যক্তির একাধিক টিআইএন নম্বর থাকতে পারে?
উত্তর: না, আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তির একটিমাত্র টিআইএন নম্বর থাকতে পারে। একাধিক টিআইএন রাখা অবৈধ।
৬. প্রশ্ন: টিআইএন ছাড়া ব্যাংক ঋণ পাওয়া যাবে?
উত্তর: সাধারণত না। বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ আবেদনের ক্ষেত্রে টিআইএন সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলকভাবে দাবি করে থাকে।
৭. প্রশ্ন: ছাত্রদের কি টিআইএন সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়?
উত্তর: যদি কোনো ছাত্রের আয়কর দাখিল করার মতো আয় থাকে তবে তার টিআইএন নেওয়া উচিত। অন্যথায় এটি আবশ্যক নয়।
৮. প্রশ্ন: অনলাইনে টিআইএন আবেদন করতে কত সময় লাগে?
উত্তর: সঠিক তথ্য দিলে অনলাইনে টিআইএন আবেদন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগে।
৯. প্রশ্ন: টিআইএন সার্টিফিকেট কি পাসপোর্টের জন্য প্রয়োজন?
উত্তর: হ্যাঁ, পাসপোর্ট আবেদনের সময় টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দেওয়া একটি প্রয়োজনীয় নথি হিসেবে বিবেচিত হয়।
১০. প্রশ্ন: কোথায় আমার টিআইএন নম্বরটি খুঁজে পাব?
উত্তর: আপনার ডাউনলোড করা ই-টিআইএন সার্টিফিকেটের উপরের ডান কোণায় ১২ ডিজিটের নম্বরটিই আপনার টিআইএন নম্বর।
১১. প্রশ্ন: টিআইএন সার্টিফিকেটের মেয়াদ আছে কি?
উত্তর: না, একবার নিবন্ধিত হলে টিআইএন সার্টিফিকেটের কোনো মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা নেই। এটি আজীবন বৈধ।
১২. প্রশ্ন: আমার দেওয়া তথ্য ভুল হলে কি করব?
উত্তর: আপনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার ই-টিআইএন প্রোফাইলে লগইন করে সহজেই ভুল তথ্যটি সংশোধন করতে পারবেন।
১৩. প্রশ্ন: টিআইএন ছাড়া গাড়ি রেজিস্ট্রেশন সম্ভব?
উত্তর: না, নতুন গাড়ি কিনে রেজিস্ট্রেশন করার সময় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ টিআইএন সার্টিফিকেট দাবি করে থাকে।




