ঢাকার পূর্বাচল উপশহরের পাশের এক গ্রামে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাতশ’ বছরের পুরনো এক খিরনিগাছ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গাছটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়, ইতিহাস ও আবেগেরও এক গভীর প্রতীক হয়ে আছে। এটি যেন এক নীরব সাক্ষী যে দেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের পরিবর্তন, অথচ নিজে অটল থেকে গেছে মাটির বুক জুড়ে।
গ্রামবাসীর মমতায় টিকে থাকা এক আশ্চর্য গাছ
স্থানীয়রা এই গাছটিকে নিজেদের পরিবারের সদস্যের মতো যত্ন করে রক্ষা করেন। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম ফকির জানান- “ফাগুন-চৈত্র মাসে এই গাছে ছোট ছোট হলুদ ফল ধরে। শিশুরা সেগুলো কুড়িয়ে খেলে আনন্দ পায়। কিন্তু কেউই এই গাছের একটি পাতাও ছিঁড়ে না।”
এই কথাগুলোই প্রমাণ করে, খিরনিগাছটি শুধু একটি বৃক্ষ নয় এটি গ্রামবাসীর বিশ্বাস, স্মৃতি ও স্নেহের প্রতীক। তাদের যত্ন আর ভালোবাসায় আজও বেঁচে আছে এই শতবর্ষী গাছটি।
উদ্ভিদতত্ত্বে খিরনিগাছ: ক্ষীরীবৃক্ষের বিস্ময়
খিরনি গাছ উদ্ভিদবিজ্ঞানে একটি বিশেষ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, যাকে বলে ক্ষীরীবৃক্ষ (latex-bearing tree)।
গাছটির ডাল বা পাতা ভাঙলে সাদা দুধের মতো একপ্রকার কষ বের হয়, যা ল্যাটেক্স নামে পরিচিত। এই বৈশিষ্ট্যই একে সফেদা ও মহুয়া গাছের আত্মীয় করে তুলেছে।
খিরনির ফল গোলাকৃতি, পাকা অবস্থায় হলুদ রঙের।
এর চারা সফেদা গাছের জোড়কলম বা রুটস্টক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফলে ও কষে রয়েছে প্রাকৃতিক ঔষধি উপাদান।
এই গাছ কেবল প্রাকৃতিক নয়, কৃষি ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
ঐতিহ্য ও ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী
প্রায় সাতশ’ বছরের পুরনো এই খিরনিগাছটি শুধু পরিবেশের অংশ নয়; এটি বাংলাদেশের প্রাচীন বৃক্ষ ঐতিহ্যের প্রতীক।
এর শিকড় মাটিতে যেমন গভীরে গিয়েছে, তেমনি ইতিহাসের পাতায়ও এর নাম খোদাই হয়ে গেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই গাছের ছায়ায় গ্রামবাসী বিশ্রাম নিয়েছে, উৎসব করেছে, গল্প শুনেছে।
এ যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত স্মৃতিফলক যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ ও গাছের বন্ধন কত গভীর হতে পারে।
সংরক্ষণের আহ্বান
আজকের দ্রুত নগরায়নের যুগে এমন প্রাচীন গাছগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এখনই প্রয়োজন
- দেশের সব শতবর্ষী গাছের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা,
- বৈজ্ঞানিকভাবে তাদের প্রকৃত বয়স নির্ধারণ করা,
- এবং আইনগতভাবে এসব গাছকে ‘প্রাকৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া।
এই খিরনিগাছ আমাদের শেখায়-প্রকৃতিকে ভালোবাসলে সে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকে।
শেষকথা
পূর্বাচলের প্রাচীন খিরনিগাছ কেবল একটি গাছ নয়- এটি বাংলার ইতিহাস, মাটি ও মানুষের সম্পর্কের প্রতীক।
এই গাছের ছায়া যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা প্রকৃতির সন্তান, আর তাকে রক্ষা করা মানে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করা।




