চলুন খোলাখুলি বলি—উনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ছিল আসলে ছেলেদের এলাকা। মেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা ছিল বন্ধ, ল্যাবরেটরি মানেই ছিল পুরুষদের ভিড়। ঠিক সেই সময়েই আবির্ভূত হলেন এক নারী—শান্ত, বিনয়ী কিন্তু ভীষণ একগুঁয়ে—মারি কুরি। তিনি শুধু এই “বয়েজ ক্লাব”-এ প্রবেশই করেননি, বরং দরজা ভেঙে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
তিনি ছিলেন প্রথম নারী নোবেলজয়ী, শুধু তাই নয়—দুই ভিন্ন বিষয়ে নোবেল পাওয়া একমাত্র মানুষ। পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন—এমন এক কৃতিত্ব, যা আজও অনন্য।
ওয়ারশ থেকে প্যারিস: এক অদম্য যাত্রা
১৮৬৭ সালে ওয়ারশতে জন্ম নেওয়া মারিয়া স্ক্লোডোভস্কা ছোটবেলা থেকেই দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবনের মুখোমুখি হন। মায়ের মৃত্যু, বাবার সংগ্রাম, দারিদ্র্য—সবকিছুই ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। তবুও জ্ঞানের প্রতি তার ক্ষুধা ছিল সীমাহীন।
রাশিয়ার দখলকৃত পোল্যান্ডে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। গোপনে পড়াশোনা করলেন “ফ্লাইং ইউনিভার্সিটি”-তে, যেখানে নারীরা অন্ধকারের মধ্যে আলোর সন্ধান খুঁজত।
পরে ১৮৯১ সালে মাত্র অল্প কিছু টাকা নিয়ে পৌঁছালেন প্যারিসে। বরফ-ঠান্ডা অ্যাটিক রুমে থাকতেন, খেতেন শুকনো রুটি, কিন্তু পড়াশোনায় সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে সোরবোন থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেন।
প্রেম, বিজ্ঞান আর নতুন আবিষ্কারের ল্যাব
প্যারিসে পরিচয় হলো পিয়েরে কুরির সঙ্গে। বিজ্ঞানপাগল এই যুগল গড়ে তুললেন এক অসাধারণ দম্পতি। তারা একসাথে আবিষ্কার করলেন রেডিওঅ্যাকটিভিটি, নতুন দুটি মৌল—পোলোনিয়াম (পোল্যান্ডের নামে) ও রেডিয়াম।
১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়। ইতিহাসে প্রথম নারী নোবেলজয়ী। অথচ সমাজে তখনও নারীর অর্জন নিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি।
হঠাৎ করেই ১৯০৬ সালে পিয়েরে দুর্ঘটনায় মারা যান। ভেঙে পড়ার বদলে মারি উঠে দাঁড়ালেন আরও দৃঢ়ভাবে। তিনি সোরবোনে প্রথম নারী অধ্যাপক হলেন এবং গবেষণায় দ্বিগুণ মনোযোগ দিলেন।
দুই নোবেল, কিন্তু কোনো পেটেন্ট নয়!
১৯১১ সালে রসায়নে দ্বিতীয় নোবেল জেতেন মারি কুরি। ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে দুইবার নোবেল পেলেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি কখনো তার আবিষ্কার থেকে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেননি। কোনো পেটেন্ট নেননি। তাঁর মতে—“বিজ্ঞান সকলের সম্পদ।” আজকের বাণিজ্যিক পৃথিবীতে এটা সত্যিই অকল্পনীয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে এক নারী সেনানায়ক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আবিষ্কার করলেন মোবাইল এক্স-রে ইউনিট—“লিটল কুরি”—যা তিনি নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান। অসংখ্য আহত সৈনিকের জীবন রক্ষা পায়। এমনকি নিজের মেকানিক্যাল দক্ষতায় গাড়ি চালিয়ে সরাসরি ফ্রন্টলাইনে পৌঁছে যেতেন।
মৃত্যুও তাকে কিংবদন্তি বানাল
তখন কেউ বুঝতে পারেনি বিকিরণ কতটা প্রাণঘাতী। তিনি প্রায়ই টেস্টটিউব ভর্তি রেডিয়াম পকেটে নিয়ে হাঁটতেন, যেন সেটা কোনো লিপবাম। দীর্ঘদিন বিকিরণের সংস্পর্শে থাকার ফলে তিনি ১৯৩৪ সালে অ্যানিমিয়ায় মারা যান।
আজও তার নোটবুকগুলো এতটাই রেডিওঅ্যাকটিভ যে বিশেষ সীসা-ঢাকা বাক্স ছাড়া এগুলো স্পর্শ করাই যায় না।
কুরিদের উত্তরাধিকার
মারি কুরির প্রভাব এখানেই থেমে যায়নি। তাঁর মেয়ে ইরেনে কুরি-ও নোবেল জয় করেন। কুরিদের পরিবার বিজ্ঞানে যেন এক রাজপরিবার।
কেন মারি কুরি আজও অনুপ্রেরণা
- প্রথম নারী নোবেলজয়ী
- ভিন্ন দুই বিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া একমাত্র ব্যক্তি
- বিজ্ঞানকে মানুষের সম্পদ ভেবে কোনো আবিষ্কারের পেটেন্ট নেননি
- যুদ্ধক্ষেত্রে হাজারো সৈনিকের জীবন বাঁচিয়েছেন
মারি কুরি ছিলেন শুধু বিজ্ঞানী নন, তিনি ছিলেন সাহস, অধ্যবসায় আর মানবতার প্রতীক। বাস্তবের সুপারহিরো—কেপ ছাড়াই।