রংপুর অঞ্চলে বহু বছর ধরে ফিরে আসা স্থানীয়ভাবে ‘মঙ্গা’ নামে পরিচিত মৌসুমি বেকারত্বের সংকট এখন অতীত। দীর্ঘমেয়াদী সরকারি উদ্যোগ ও ব্যাপক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ফলে রংপুরে মঙ্গা কেটে এখন স্থায়ী কর্মসংস্থান ও আর্থিক স্বচ্ছলতা তৈরি হয়েছে।
দেড় দশক আগেও আশ্বিন ও কার্তিক মাস মানেই ছিল দুর্দশার সময়। দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষ তখন কাজের অভাবে কষ্টে দিন কাটাতেন। কিন্তু এখন তারা একই সময়ে চাষাবাদ, ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও মৌসুমি ফসলের মাধ্যমে স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন।
গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষণ
‘নর্থবেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’-এর চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ শামসুজ্জামান বলেন, “এই সাফল্য এসেছে ধারাবাহিক ও বিস্তৃত সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে।”
তিনি আরও জানান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (SSNP) এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।
কার্যকর প্রকল্প ও কর্মসূচি
মঙ্গা মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে-
- স্বল্প মেয়াদী আমন ধানের বিস্তৃত চাষ
- টেস্ট রিলিফ (TR)
- খাদ্যের বিনিময়ে কাজ (FFW)
- টাকার বিনিময়ে কাজ (CFW)
- ভিজিডি ও ভিজিএফ প্রকল্প
- গৃহহীনদের পুনর্বাসন
- ক্ষুদ্রঋণ ও আয়বর্ধক কর্মসূচি (IGA)
এসব উদ্যোগের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্য ও কর্মসংস্থানে নিরাপত্তা পেয়েছেন।
কৃষিতে স্বল্প মেয়াদী আমন ধানের অবদান
কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ বলেন, “স্বল্প মেয়াদী আমন ধানের চাষ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাস্তবায়ন মঙ্গা মোকাবিলায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।”
আশ্বিন ও কার্তিক মাসে এই ধান কাটার ফলে বিপুল পরিমাণ মৌসুমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এতে কৃষিশ্রমিক ও প্রান্তিক পরিবারগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান,
এই মৌসুমে পাঁচ জেলায় ৬,২১,৫০৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে, যার মধ্যে ৬২,০০০ হেক্টর স্বল্প মেয়াদী জাত।
এর মধ্যে প্রায় ২০,০০০ হেক্টরের ধান ইতোমধ্যে কাটা হয়েছে – যা দরিদ্র কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিশাল কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
ধান কাটার পর একই জমিতে আলু, সরিষা, শাকসবজি ও শীতকালীন ফসল চাষ করা হচ্ছে, যা সারা বছর আয়ের উৎস সৃষ্টি করছে।
যুব উন্নয়ন ও ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল ফারুক জানান,
রংপুরে ৪০,০০০-এর বেশি বেকার যুবক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং অনেকেই সুদমুক্ত ঋণ নিয়ে আত্মনির্ভর হয়েছেন।
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক শাহিদুর রহমান সুমন জানান,
তাদের প্রকল্পগুলো হাজারো পরিবার ও ক্ষুদ্র কৃষককে আত্মনির্ভরশীল করেছে।
রংপুর পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মাহিদুল ইসলাম জানান,
৪৫,০০০ গ্রামীণ উপকারভোগী, যার মধ্যে ৩০,০০০ নারী, সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন।
তারা পেয়েছেন ঘূর্ণায়মান ঋণ, এসএমই ঋণ এবং ফলচাষ, পশুপালন, মাছচাষ ও নার্সারির প্রশিক্ষণ।
মঙ্গা এখন ইতিহাস
গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাইমিন ইসলাম মারুফ বলেন, “এসএসএনপি, ক্ষুদ্র উদ্যোগ, কুটির শিল্প, পশুপালন ও স্বল্প মেয়াদী আমন ধানের বিস্তৃত চাষ মঙ্গাকে স্থায়ীভাবে নির্মূল করেছে।”
ড. শামসুজ্জামান আরও বলেন, “আজ ‘মঙ্গা’ শব্দটি ইতিহাসের অংশ বাস্তবের নয়।”




